• ৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ৫ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

আমাদের একজন ফজলুর রহমান বাবু আছেন…

নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত আগস্ট ২২, ২০১৯
আমাদের একজন ফজলুর রহমান বাবু আছেন…

“মুরুব্বী, মনডা একটু শক্ত করেন!”

যাকে উদ্দেশ্য করে এই সংলাপটি বলা হয়েছিল, সেই মানুষটা এই সংলাপ শোনার এক সেকেন্ডের মাথায় শক্ত হয়ে গেলেন। তার চোখের আর মুখের এক্সপেরেশন মুহূর্তে বদলে গেল। এই একটি লাইন শুনেই তিনি বুঝে গেলেন- খারাপ একটি সংবাদ অপেক্ষা করছে তার জন্য, এতটাই খারাপ যে তার শক্ত মনটাকে আরও শক্ত করে ফেলতে হবে। দর্শক হিসেবে বারবার শুধু মনে হয়- এত দ্রুতও কি কোন মানুষের পক্ষে এক্সপ্রেশন চেঞ্জ করা সম্ভব? 

হ্যাঁ, সম্ভব। যদি মানুষটার নাম হয় ফজলুর রহমান বাবু। 

উপরের এই সংলাপটি পুলিশরুপী শতাব্দী ওয়াদুদ যখন ফজলুর রহমান বাবুকে তার ছেলের মৃত্যু সংবাদ দিতে আসে, তখন বলে। সিনেমার নাম- অজ্ঞাতনামা। যারা দেখেছেন তারা বুঝতে পারবেন ঐ দৃশ্যে ফজলুর রহমান বাবু কতটা অসাধারণ ছিলেন। নিজের ছেলের মৃত্যুর সংবাদ শুনে বাবুর স্ত্রী যেখানে “আল্লাহ রে” বলে কাঁদছিলেন- সেখানে বাবুর এক্সপ্রেশন ছিল একদম আলাদা। কনফিউজড, নিজের কষ্ট চাপিয়ে রাখা, নিজের কষ্ট বলার মতো কাউকে চারপাশে খোঁজা– অসাধারণ, শুধুই অসাধারণ!

এমন না যে ফজলুর রহমান বাবু আগে অসাধারণ ছিলেন না। তবে ইদানিং যেন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছেন, ইদানিং তার এক একটি পারফর্মেন্স দেখে বিস্ময়ে বোবা হয়ে যেতে হয়।

এই মানুষটি যে একদিন অসাধারণ অভিনেতা হবেন, সেটি সম্ভবত ছোটবেলাতেই বোঝা গিয়েছিল। স্কুলে পড়া অবস্থায় মঞ্চনাটক তাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করত। ক্রমে ঝোঁক বাড়তে থাকে মঞ্চনাটকের প্রতি। এইচএসসি পরীক্ষার পর পরই ফরিদপুরের ‘বৈশাখী নাট্যগোষ্ঠী’র হয়ে বিভিন্ন মঞ্চনাটকে অভিনয় শুরু করেন। বিচিত্র অভিনয়ের মাধ্যমে নজর কাড়তে সক্ষম হন আরণ্যক নাট্যদলের পরিচালক ও অভিনেতা মামুনুর রশীদের। ১৯৮৩ সালে আরণ্যকে যোগ দেন। মামুনুর রশীদের কাছে শিখতে শুরু করেন অভিনয়ের নানা বিষয়, অভিনয়ের কলাকৌশল। এ নাট্যদলের হয়ে বেশ ক’টি মঞ্চনাটকে অভিনয় করেন। এগুলোতে সফলতা পাবার পর ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত শিল্পী হলেন বাবু।

’৯১ সালে কাজী নজরুল ইসলামের গল্প অবলম্বনে নাটক ‘মৃত্যু ক্ষুধা’ প্রচারিত হয় বিটিভিতে। এটি ছিল টেলিভিশনে অভিনয় করা বাবুর প্রথম নাটক। তারপর মামুনুর রশীদের কয়েকটি ধারাবাহিক নাটকে অভিনয়ের সুযোগ হয়। এতেই টিভি দর্শকদের কাছে পরিচিতি বাড়তে থাকে তার। এভাবে শ’খানেক নাটকে অভিনয় করা হয়ে গেল।

কাজের সংখ্যার পরিমাণ একশ হোক বা হাজার, বাবুকে তার কাজের জন্য আলাদা করা যায় সবসময়ই। ফজলুর রহমান বাবুর অভিনয় দর্শকরা ভিন্নতার স্বাদ পায়। তার অভিনয় একঘেয়েমি মনে হয় না। যখন সংলাপ বলেন, তখন মনে হয় না এটি নাটকের সংলাপ, মুখস্থ করা, কারো শিখিয়ে দেয়া। মনে হয়, তা যেন তারই অন্তর-উদ্গীরিত শব্দমালা। মনে হয়- হ্যাঁ, এই সিচুয়েশনে তো এটাই বলার কথা ছিল! ফলে দর্শকেরা খুব সহজেই আকৃষ্ট হয় তার প্রতি। অভিনেতা হিসেবে তার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাবোধ তৈরি হয়। তার নাটকের চরিত্রও বিচিত্র রকমের। কখনোই নিজেকে একই ফ্রেমে বন্দী করে রাখতে পছন্দ করেননি তিনি।

ফজলুর রহমান বাবু শুধু নাটকে অভিনয়ের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। এর বাইরে চলচ্চিত্রে অভিনয় করেও দর্শকের বিপুল প্রশংসা কুড়িয়েছেন। গোলাম রব্বানীর বিপ্লবের ‘স্বপ্ন ডানায়’, ‘বৃত্তের বাইরে’, এনামূল করিম নির্ঝরের ‘আহা’ ও গিয়াস উদ্দিন সেলিমের ‘মনপুরায়’ অভিনয়ের কথা কি সহজে ভোলা যায়? ‘আহা’ সিনেমার সেই কাজের লোক, সেই গুপ্তঘাতক কিংবা ‘মনপুরা’ সিনেমার নায়িকার বাবা। নদীর জেলে। মাছ শিকার করে সংসার চলে। তখন বাবুকে চেনা যায় না। যেন এ বাবু নয়, সমুদ্রগামী কোনো নদীর অপরিচিত জেলে।

তবে যে দুইটি পারফর্মেন্স এর কথা না বললেই না- সেটা হচ্ছে শঙ্খনাদ ও অজ্ঞাতনামা। শঙ্খনাদ চলচ্চিত্রে ব্যতিক্রমধর্মী অভিনয় করেছেন। ওই চলচ্চিত্রে তার চরিত্র ছিল কাপড় চুরি করা। রাতের আঁধারে কবর খুঁড়ে লাশের পরনের কাফনের কাপড় চুরি করা। এ কাপড় চুরি করে বিক্রি করতেন। এই ব্যতিক্রমধর্মী চরিত্রে অভিনয়ের কারণে ২০০৪ সালে সেরা পাঁচ চলচ্চিত্র অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।

আর অজ্ঞাতনামায় তিনি কি করেছেন, সেটা হয়তো নতুন করে আর না বললেও চলবে। অনেক কষ্ট করে বিদেশে পাঠানো সন্তানের লাশ নিয়ে একজন বাবাকে যে কি পরিমাণ দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে যেতে হয় এই দেশে, সেটা সম্ভবত ফজলুর রহমান বাবু ছাড়া আর কেউ এত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন না।

শুধু অভিনেতা নন, আরও অনেক পরিচয় আছে বাবুর। চলচ্চিত্র ছাড়াও তিনি একাধিক বিজ্ঞাপনচিত্রে কাজ করেছেন। এমনকি বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেলও দিয়েছেন। বাবু প্রথম জিঙ্গেল করেছিলেন নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে। সেটি ছিল যক্ষ্মার সচেতনতা তৈরির বিজ্ঞাপন। সত্য সাহার সঙ্গীত পরিচালনার গানটি ছিল ‘মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে’। এই মানুষটার গানের গলার অসাধারণ। মনপুরা সিনেমার নিধুয়া পাথারে এখনো অনেকে গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠেন। বেশ কিছু মিক্সড আর একক এ্যালবাম আছে ফজলুর রহমান বাবুর।

বাবুর সম্প্রতি সেরা দুইটি কাজ হচ্ছে- অলিম্পিক এনার্জি প্লাস বিস্কুটের বিজ্ঞাপন আর আদনান আল রাজীবের পরিচালনায় বিকাল বেলার পাখি নাটকে অভিনয়। “বাপ হও, তহন বুঝবা” বলে ৪ মিনিটের বিস্কুটের অ্যাডে তিনি বাবার স্নেহ যেভাবে দেখিয়েছেন, সেটা হয়তো অনেক সিনেমাতেও দেখতে পারিনা আমরা। আর বিকাল বেলার পাখিতে তার কাজের জন্য কত ইউটিউবমুখী মানুষ বা টিভি নাটক দেখতে ভুলে যাওয়া মানুষ যে আবারও টিভিমুখী হয়েছে- সেটা গত কয়েক দিন ফেসবুকেই দেখা যাচ্ছে।

অভিনয় নিয়ে বাবু বলেন- “আমি একজন অভিনেতা। আরো কিছুদিন অভিনয় করতে চাই। কারণ অভিনয়কে এখনো আমি ভালোবাসি। অভিনয় এখনো আমাকে টানে, তাই এ মুহূর্তে কোনো ইচ্ছাই নেই নির্মাতা, প্রযোজক অথবা পরিচালক হবার।’

বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা হচ্ছে, একজন অভিনেতা কোন একটি নির্দিষ্ট ক্যারেক্টারে ভাল অভিনয় করলে তাকে ক্রমাগত সেই ক্যারেক্টার প্লে করতে দেয়া হয়। এই জিনিসটা হচ্ছে মোশাররফ করিমের সাথে। কমেডি ভালো করেন বলে কমেডি করতে করতে এখন কমেডি আর ভাঁড়ামির মাঝে কোন পার্থক্য রাখেন নি এই অসাধারণ অভিনেতা।

বাবুর ভাগ্যেও মনে হয় আমাদের নির্মাতারা এমন কিছু করার প্ল্যান করছেন। নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত বাবার ভূমিকায় তার অভিনয় অসাধারণ লেগেছে বলে দেখা যাবে এখন লেবু কচলানোর মতো তাকে বারবার সেসব ক্যারেক্টারেই নেয়া হচ্ছে যেটা করা একেবারেই উচিত হবে না। বাবুর সামর্থ্যের পরিমাণ অনেক বেশি, আমাদেরকে আরও অনেক বিচিত্র ক্যারেক্টারে বিচিত্র অভিনয় দেয়ার ক্ষমতা আছে তার। আমাদের নির্মাতারা যেন সেটা বোঝার চেষ্টা করেন। হুমায়ূন ফরীদি নেই, কিন্তু ফজলুর রহমান বাবু আছে। ফরীদিকে ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারিনি বলে এখন আমরা অনেকেই আফসোস করি, সেই আফসোস যেন ফজলুর রহমান বাবুকে নিয়ে না করতে হয়।

ফজলুর রহমান বাবু মতো অভিনেতা যেন আফসোসের অপর নাম না হন- একজন মুগ্ধ দর্শক হিসেবে এটাই চাওয়া।

সৌজন্যে – এগিয়ে চলো ডট কম

September 2024
S S M T W T F
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930