সাংবাদিক, লেখক, সম্পাদক এম আর আখতার মুকুলের পুরো নাম মুস্তাফা রওশন আখতার মুকুল। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত সাড়া জাগানো অনুষ্ঠান ‘চরমপত্র’-এর কথক ছিলেন তিনি। তাঁর সৃষ্টি ‘চরমপত্র’ ছিলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে প্রবল পরাক্রমশালী এক প্রেরণার নাম। এম আর আখতার মুকুল জন্ম নেন ১৯২৯ সালের ৯ আগস্ট বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়ের চিংগাসপুর গ্রামে। বিশিষ্ট সাহিত্যিক সাদত আলী আখন্দ এবং রাবেয়া খাতুনের সন্তান তিনি। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি সক্রিয় ছিলেন রাজনীতিতে এবং এ কারণে তাঁকে জেলও খাটতে হয়েছে বেশ কয়েকবার। ১৯৪৮-৪৯ সালে জেল থেকেই স্নাতক পরীক্ষা দেন এবং সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৪১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। জীবিকার জন্য চাকরি করেছেন বীমা কোম্পানি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বিজ্ঞাপনী সংস্থা, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন বিভাগসহ বিভিন্নক্ষেত্রে। তবে সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছেন সাংবাদিকতার পেশায়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের যে অনুষ্ঠানটির জন্য প্রতিদিন মুক্তিযোদ্ধাগণ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন সেটি ছিলো “চরমপত্র”, যার পরিচালক, পাঠক দুটোই ছিলেন এম আর আখতার মুকুল। পাকিস্তানি সেনা আর রাজাকারদের প্রতি একরাশ ঘৃণা ছড়ানো কন্ঠে তিনি পড়তেন – “আইজ ভেড়ামারার কাছে আমাগো বিচ্চু পোলাপাইনরা এমুন মাইর দিচে, কমসে কম তেরজন পাকি সৈন্য প্যাঁকের মধ্যে পইড়্যা কাঁতরাইতাছে”। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে তিনি বলতেন “বিচ্ছু” । চরম পত্র স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের যেমনি শক্তি, সাহস, মনোবল বৃদ্ধিতে সহায়ক ছিল, তেমনি বিপক্ষ শক্তিকে নিরোৎসাহ ও দূর্বল করে রাখতো। চরম পত্র যুবকদেরকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে সে সময় প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত করেছে।
পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে প্রচারিত এই চরম পত্র কে বা কারা করতো, তা কেউ জানতে পারেনি। চরম পত্রের শেষ অনুষ্ঠান হয় ১৯৭১ সালে ১৬ই ডিসেম্বর। সেদিন তিনি তাঁর পরিচয় দেন বাংলাদেশের মানুষের কাছে। ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ‘চরমপত্র’র শেষ অংশটুকু ছিল এরকম – “কি পোলারে বাঘে খাইলো? শ্যাষ। আইজ থাইক্যা বঙ্গাল মুলুকে মছুয়াগো রাজত্ব শ্যাষ। ঠাস্ কইয়্যা একটা আওয়াজ হইলো। কি হইলো? কি হইলো? ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পিঁয়াজী সাবে চেয়ার থনে চিত্তর হইয়া পইড়া গেছিলো। আট হাজার আষ্টশ চুরাশী দিন আগে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট তারিখে মুছলমান-মুছলমান ভাই-ভাই কইয়া, করাচী-লাহুর-পিন্ডির মছুয়া মহারাজরা বঙ্গাল মুলুকে যে রাজত্ব কায়েম করছিলো, আইজ তার খতম্ তারাবী হইয়া গেলো। আইজ থাইক্যা বঙ্গাল মুলুকে মছুয়াগো রাজত্ব শ্যাষ। আইজ ১৬ই ডিসেম্বর। চরমপত্রের শ্যাষের দিন আপনাগো বান্দার নামটা কইয়া যাই। বান্দার নাম এম আর আখতার মুকুল।”
আজ এম আর মুকুল আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু অস্ত্রহীন এই কণ্ঠবীরের “চরম পত্র”-এর কথা জাতি ভুলবেনা কোনদিন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তাঁর ভূমিকা আলোচিত হবে, আলোকিত করবে আগামী বহু প্রজন্মকে। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিনের যুদ্ধ শেষে এই কিংবদন্তী ২০০৪ সালের ২৬জুন মৃত্যুবরণ করেন। ভালো থাকবেন শ্রদ্ধেয় শব্দ সৈনিক, ভালো থাকবেন এম আর আখতার মুকুল।
হাকালুকিডটনেট/এমএন