• ৩রা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১৮ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ৩০শে রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

কপ-২৯কে বছরে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের নতুন জলবায়ু অর্থায়নের লক্ষ্যে একমত হওয়ার আহ্বান

নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৪
কপ-২৯কে বছরে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের নতুন জলবায়ু অর্থায়নের লক্ষ্যে একমত হওয়ার আহ্বান

বছরে জীবাশ্ম জ্বালানি প্রতিষ্ঠান ও বাণিজ্যিক কৃষি খাতে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে প্রায় ৬৭৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি। আর এই ভর্তুকি গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা বাড়িয়ে তুলছে। উন্নত দেশগুলো এই ভর্তুকি দানে উৎসাহ দিচ্ছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসে ভূমিকা রাখছে এমন অনেক ব্যবসা সরকারি পর্যায়ে ভর্তুকি পাচ্ছে। উন্নত দেশগুলো জীবাশ্ম জ্বালানিতে অর্থায়নের মাধ্যমে জলবায়ু সংকট সৃষ্টি করছে।
আজ সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর গুলশানে অবস্থিত একটি হোটেলের কনভেনশন সেন্টারে একশনএই বাংলাদেশ-এর আয়োজিত অনুষ্ঠানে সমীক্ষার ফলাফলে এই তথ্য উঠে এসেছে। এসময় জলবায়ু বিপর্যয় প্রতিরোধ বিষয়ক ক্যাম্পেইন ‘ফান্ড আওয়ার ফিউচার’ উন্মোচন করা হয়।
অনুষ্ঠানে একশনএইড ইন্টারন্যাশনাল দ্বারা পরিচালিত ‘হাউ দ্য ফাইন্যান্স ফ্লো’ শীর্ষক সমীক্ষাটি প্রকাশ করা হয়। সমীক্ষায় বৈশ্বিক দক্ষিণের জনগণের টাকা কীভাবে জলবায়ু ধ্বংসের পেছনে খরচ হচ্ছে এবং এই অর্থ দিয়ে কীভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি ও বাণিজ্যিক কৃষি খাতগুলো লাভবান হচ্ছে সেসব চিত্র দেখানো হয়।
সমীক্ষায় দেখা যায়, ২০১৬ সালে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যারিস চুক্তি গৃহীত হওয়ার পর থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত, বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলোর জনগণের ভর্তুকির টাকা প্রতি বছর ৪৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যাচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানি খাতে। এবং বাণিজ্যিক কৃষি খাত এই ভর্তুকি থেকে প্রতি বছর ২৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার লাভবান হচ্ছে।
সমীক্ষায় আরও বলা হয়েছে, বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলোর নবায়নযোগ্য শক্তি রূপান্তরে যে অর্থ ব্যয় করা হয় তা ভর্তুকির তুলনায় আশ্বর্যজনকভাবে নগণ্য। ৪০ ভাগের ১ ভাগ অর্থ ব্যবহার হয় নবায়নযোগ্য শক্তিতে। টেকসই ও সবুজ নবায়নযোগ্য শক্তিতে অর্থায়নের হার নিম্নমুখী। পাশাপাশি আগের থেকে বেশি দেশ এ জলবায়ু সংক্রান্ত ঋণঝুঁকিতে রয়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানিতে ভর্তুকির অর্থায়নের পরিমাণ জলবায়ুর সংকটের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলোর সাধারণ মানুষের মাথাপিছু ৫০ শতাংশেরও বেশি।
এসময় একশনএইড বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবিরের সঞ্চালনায়ে একটি প্যানেল আলোচনার আয়োজন করা হয়। নাগরিক সংগঠন (সিএসও), জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা, স্থানীয় সংগঠনের পরিবেশ ও জ্বালানিখাতের বিশেষজ্ঞ, অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা এই আলোচনায় অংশ নেন।
প্যানেল আলোচনায় বক্তারা বলেন, জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলো যে পরিমান জলবায়ু অর্থায়ন অনুদান পাচ্ছে তা সর্বমোট ভর্তুকির ২০ ভাগের এক ভাগ। যা জলবায়ু ধ্বংসের বিপরীতে জলবায়ু মোকাবেলার তুলনায় অপর্যাপ্ত। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব পড়ছে বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলোর তরুণ, কৃষক, নারী এবং প্রান্তিক সম্প্রদায়গুলোতে। এ অবস্থায় জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে টেকসই প্রকল্প এবং নবায়নযোগ্য শক্তির ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এলক্ষ্যে আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৯কে বছরে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের নতুন জলবায়ু অর্থায়নের লক্ষ্যে একমত হতে হবে। এই জলবায়ু অর্থায়ন নিশ্চিত ও সুপরিকল্পিত কর্ম-পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে জলবায়ুর ক্ষতিপূরণ সম্ভব।
একশনএইড বাংলাদেশে-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, “এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে যে কীভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি এবং বাণিজ্যিক কৃষি প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের জলবায়ু সংকটের মূল চালক হিসেবে কাজ করছে। আমাদের লক্ষ্য নির্ধারণ, জবাবদিহিতা এবং পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের অবশ্যই ন্যায়বিচার চাইতে হবে এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক আহমেদ জুবায়ের বলেন, ‘গ্রিন এনার্জির বাস্তবসম্মত কী কী বিকল্প আছে তা ভেবে দেখা দরকার। আমরা তহবিল পাই কিন্তু এটার প্রক্রিয়া একটু জটিল। তা সহজ করা যায় কী না। ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট মিটিগেজেশনের থেকে ক্লাইমেট অভিযোজনের দিকে আমাদের বেশি মনযোগ দিতে হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাসটেইনেবিলিটি ফাইন্যান্স বিভাগের সাবেক পরিচালক মোর্শেদ মিল্লাত বলেন, ‘জলবায়ু তহবিল ব্যবহারের থেকে স্বচ্ছতা আনা বেশি জরুরি। দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে যেসব পলিসি রয়েছে তা মাঠ পর্যায়ে চর্চায় নিতে হবে।’
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, ‘জ্বালানির প্রাপ্তি বৃদ্ধিতে বিদ্যমান নবায়নযোগ্য শক্তির অন্যান্য উৎসগুলো বাড়াতে হবে। সাথে আমাদের জনসংখ্যার তুলনায় জমির পরিমান কমে যাচ্ছে। সবুজ কৃষি রূপান্তরের লক্ষ্যে ক্ষতিকর সারের ব্যবহার কমিয়ে জৈব সার ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে জমির সর্বোচ্চ উপযোগিতা নেয়ার পরিকল্পনার সাথে নিতে হবে।’
জার্মান দূতাবাসের হেড অব জার্মান ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন কাউন্সেলর ফ্লোরিয়ান হেলেন বলেন, ‘বাংলাদেশের জ্বালানি খাত পুনর্গঠন করতে হবে। সরকারকে গ্রিন এনার্জি ট্রানজিশন নিয়ে এমনভাবে উদ্যোগ নিতে হবে যাতে মানুষ এতে আগ্রহ দেখায়। এবং বাংলাদেশে যেসব জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনে পাওয়ার প্ল্যান্ট রয়েছে সেগুলো কীভাবে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনে রূপান্তর করা যায় সেটা ভেবে দেখতে পারে সরকার।’
ব্র্যাক ব্যাংকের চিফ অপারেটিং অফিসার সাব্বির হোসেন বলেন, ‘ঢাকার বাসা-বাড়ির ছাদে ব্যবহারকৃত ১০০ ভাগের ৮০ ভাগ সোলার প্যানেলই অকার্যকর হয়ে আছে। কিন্তু এসব নিয়ে পর্যালোচনা করা হয় না। এখন নতুন করে পুনর্মুল্যায়ন করে সোলার নিয়ে নতুন ভাবে পরিকল্পনা করার সময় এসেছে।’
একশনএইড ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ সোসাইটির চেয়ারপার্সন ইব্রাহিম খলিল আল জায়াদ বলেন, ‘জ্বালানি নিয়ে নতুন করে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমন্বয়মূলক পলিসি করার সুযোগ এসেছে। জলবায়ু পরিবর্তন, সবুজ জ্বালানি ও নবায়নযোগ্য শক্তি নিয়ে গবেষণা বাড়াতে হবে। আমাদের জ্বালানি সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে নতুন পদ্ধতি বের করতে হবে।’
প্রতিবেদনে জলবায়ু সুরক্ষা ও জলবায়ুতে অর্থায়নের নিশ্চিতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে অর্থায়ন বন্ধ, নবায়নযোগ্য শক্তির সম্প্রসারণ ও টেকসই কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়। জনগণের টাকা জীবাশ্ম জ্বালানি ও বাণিজ্যিক কৃষি খাত থেকে ন্যায়সংগত পরিবর্তন করে মানুষের অধিকার খাদ্য, জ্বালানি ও জীবিকাসহ জলবায়ু সুরক্ষা নিশ্চিতে ব্যবহার করার কথা বলা হয়। উন্নত দেশগুলো যাতে প্রতি বছর জলবায়ু সুরক্ষায় অর্থায়ন বাড়ায় সে ব্যাপারে জোর দাবি তোলাসহ কপ২৯-এ জলবায়ু সংকটে ক্ষতিগ্রস্তদের ট্রিলিয়ন ডলার জলবায়ু অর্থায়ন লক্ষ্য নির্ধারণের ব্যাপারে সম্মত হওয়ার কথা বলা হয়। জ্বালানি প্রাপ্তির জন্য বিকেন্দ্রীকরণ জ্বালানি পদ্ধতির ব্যবহার বিস্তার করা এবং নারীবান্ধব কৃষি সেবা বাড়ানো, যা কৃষিবিজ্ঞানের প্রশিক্ষণ এবং অভিযোজনের সুযোগ প্রদান করবে। জীবাশ্ম জ্বালানী সম্প্রসারণে অর্থায়ন বন্ধ করতে জাতীয় এবং আঞ্চলিক সরকারকে অবশ্যই ব্যাংকিং এবং আর্থিক খাতগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলা হয়।
এসময় অনুষ্ঠানে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের (ইডকল) হেড অব রিনিয়েবল এনার্জি এনামুল করিম পাভেল, এইচএসবিসি-র কর্পোরেট সাসটেইনেবিলিটির প্রধান সৈয়দা আফজালুন নেসা, একশনএইড বাংলাদেশ-এর জাস্ট এনার্জি ট্রানজিশন টিমের ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ, রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট জাসটিস টিমের ডেপুটি ম্যানেজার তানজিয়া আনজুমসহ নাগরিক সংগঠন (সিএসও), জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা, স্থানীয় সংগঠনের পরিবেশ ও জ্বালানিখাতের বিশেষজ্ঞ, অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বক্তব্য রাখেন।

October 2024
S S M T W T F
 1234
567891011
12131415161718
19202122232425
262728293031