• ২৬শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ১২ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ২৬শে রমজান, ১৪৪৬ হিজরি

পাপনের যে গল্প আপনারা জানেন না হয়তো…

নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত আগস্ট ২১, ২০১৯
পাপনের যে গল্প আপনারা জানেন না হয়তো…

“আমার সামনে তখন লাশের স্তুপ, আম্মার কাছে যেতে হলে সেই লাশ ডিঙিয়ে যেতে হবে, উপায় নাই যাওয়ার কোন। আমি তখন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, “আম্মা তুমি চিন্তা কইরো না, আমি চলে আসছি।” জানি না কেন যেন আম্মা মাথাটা নাড়লেন তখন, বুঝলাম যে উনি বেঁচে আছেন। ওখানে যারা ছিল, তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম যে এখন কি করতে হবে৷ ওরা একটা লিস্ট দিয়ে বললেন, এক্ষুণি এই এই ওষুধগুলা লাগবে৷ আমি বললাম যে, ঠিক আছে, আপনাদের এখানেই তো ফার্মেসি আছে, তাই না? ওরা বললো যে না, হাসপাতালের ফার্মেসি বন্ধ। এটা আজকে আর খুলবে না৷ আশেপাশে অনেক ওষুধের দোকান, শত শত। সব বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, কোন ওষুধ পাবে না কেউ!”

“এরমধ্যে অবস্থার আরও অবনতি হচ্ছে, কারণ রক্তক্ষরণ থামানো যাচ্ছে না৷ একজন এসে বললো, এই মূহুর্তে অপারেশন করতে হবে৷ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ডাক্তারের অভাব নাই। আমি বললাম, তাড়াতাড়ি ডাকেন তাহলে। ওরা বললো, কাকে ডাকবো? কোন ডাক্তার নাই। আম্মাকে যে একটু দেখবে, সার্জারী করবে, সেরকম একটা ডাক্তারও তখন নাই, সবাইকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। দেখতে দেখতে প্রায় তিন ঘন্টা চলে গেল।”

“আমরা ঠিক করলাম, আম্মাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে হবে৷ এমন একটা জায়গায় নিয়ে যেতে হবে, যেখানে আম্মা একটু চিকিৎসা পেতে পারে। অলরেডি এত রক্তক্ষরণ হয়েছে… কোনরকমে আম্মাকে ধরে তুললাম, একটা অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করে সেটাতে ওঠালাম। পিজি হাসপাতালে নিয়ে যাবো। গেট দিয়ে বের হবো, এমন সময় চারদিক থেকে পুলিশের বাধা, কোথায় নাকি যাওয়া যাবে না। আহত কাউকে কোথাও নিয়ে যাওয়া যাবে না! আমি বললাম, তাহলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন আপনারা। ডাক্তার আনেন, ওষুধ আনেন৷ ওরা বললো, ওপরের নির্দেশ, আমরা কোথাও যেতে দিতে পারব না!”

“যাই হোক, তখন আমিও ফোনটোন করা শুরু করলাম। একটা পর্যায়ে তারা বললো, আম্মাকে শুধু সিএমএইচে আমরা নিয়ে যেতে পারব, আর কোথাও না। ভেবে দেখলাম, এখানে তো কোন চিকিৎসাই হচ্ছে না, পানির মতো রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে শরীর থেকে। সিএমএইচ তো ভালো, ওখানে গেলে নিশ্চয়ই চিকিৎসা হবে।”

“এই কাহিনীগুলা বলার মতো না আসলে। ক্যান্টনমেন্টের গেটে বসিয়ে রাখলো একঘন্টা, ঢুকতে দিবে না! সিএমএইচে যাওয়ার পর বলে, আর্মি অফিসারের রেকমেন্ডেশন লাগবে! আমার আম্মা ওখানে পড়ে আছে রক্তাক্ত অবস্থায়, মানুষটা মারা যাচ্ছে, এরকম অবস্থায় টানা আট-নয়টা ঘন্টা আমার আম্মাকে কোন চিকিৎসা দেয়া হয় নাই।”

“একুশ তারিখে গ্রেনেড হামলাটা হয়, তেইশ তারিখ রাত বারোটায় আমি সিএমএইচ থেকে বাসায় আসি। পরদিন থেকে আটচল্লিশ বা বাহাত্তর ঘন্টার হরতাল, আওয়ামী লীগ ডেকেছিল। ঠিক রাত দুটোর সময় আমাকে ফোন করা হলো, বললো, খবর পেয়েছেন তো? আমি বললাম কি খবর? বললো, আপনার আম্মা তো মারা গেছেন৷ একটু আগে দেখে গেলাম মানুষটা বেঁচে আছেন, এর মধ্যেই মরে গেলেন! আমি বললাম, ঠিক আছে, আমি আসছি।”

“ফোনের ওপাশ থেকে বললো, এসে কোন লাভ নাই, আমরা দাফন করে দিচ্ছি। আমি বললাম, দাফন করবেন মানে? আমাদের আত্মীয় স্বজন আছে, আমার আব্বা আছেন, সবাইকে জানাতে হবে, জানাজা পড়াইতে হবে, কবর দেয়া- এগুলো আমরা করব। ওরা বললো যে না, ওপরের নির্দেশ, সব এখানেই করতে হবে! লাশ বাইরে নেয়া যাবে না! কিসের মধ্যে দিয়ে যে গেছি আমি, আজ পর্যন্ত এগুলা কাউকে বলি নাই৷”

“কি বলব বলেন? এত কিছু করার পরেও, মানুষের মধ্যে তো মনুষ্যত্ববোধ বলে একটা জিনিস থাকে। এরা কি রাজনীতি করে? বোমা মারলো, হামলা করলো, শত শত মানুষ আহত-নিহত, তাদের চিকিৎসাটাও করতে দিলো না! লাশও নাকি দিবে না! এটা কিসের রাজনীতি রে ভাই?”

কথাগুলো নাজমুল হাসান পাপনের। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি, আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সাংসদ, যাকে নিয়ে আমরা প্রায়শই নানা কারণে ট্রল করি। তার আরও একটা পরিচয় আছে, তিনি একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলায় নিহত আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানের সন্তান। গ্রেনেড হামলায় আইভি রহমান আহত হবার পর থেকে তার মৃত্যুর পর পর্যন্ত সময়গুলো কিভাবে কাটিয়েছিলেন, সেসবেরই স্মৃতিচারণ করছিলেন নাজমুল হাসান।

একটা রাজনৈতিক দলকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্যে এমন নোংরা ষড়যন্ত্র আর কখনও বাংলাদেশের মাটিতে হয়েছিল কিনা আমাদের জানা নেই। সেই আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়। তাদের হাতে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা দমন-নিপীড়নের শিকার হন না, এমন কোন দাবী করছি না। কিন্ত ২০০৪ সালের একুশে আগস্টে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে যেটা ঘটেছিল, সেই নৃশংসতার সঙ্গে অন্য কোন কিছুকেই মেলানো যাবে না। আরও পঞ্চাশ বছর ক্ষমতায় থাকলেও বোধহয় আওয়ামী লীগের পক্ষে এতটা হিংস্র হওয়া সম্ভব হবে না৷ এখন যখন বাকস্বাধীনতা, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড জাতীয় শব্দগুলো শুনি, তখন সেই অন্ধকার যুগের কথা মনে পড়ে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নামের বস্তুটা তো তখন ডিকশনারিতেও খুঁজে পাওয়া যেতো না!

March 2025
S S M T W T F
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031