২০০৭ সালের ১৬ জুলাই, মঙ্গলবার শ্রাবণের বৃষ্টিমুখর ভোরে সুধাসদন-এ প্রবেশ করে যৌথবাহিনী। এর আগে, রাত থেকেই দেশরত্ন শেখ হাসিনার বাসভবনকে ঘিরে রেখেছিল দুই সহস্রাধিক পুলিশ, র্যাব, ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা। মধ্যরাতে তুলে নেওয়া হয় তার বাসার নিরাপত্তা ব্যবস্থা। অরক্ষিত অবস্থাতেই ফজরের নামাজ আদায় করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। এরপর বের হয়ে আসেন সাদা শাড়ি পরে। সকাল সাড়ে ৭টা, একটি সাজানো মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে তড়িঘড়ি করে নেওয়া হয় সিএমএম কোর্টে। কাকডাকা সকালে দ্রুত আদালত বসিয়ে তার জামিন আবেদন খারিজ করে, বন্দি করা হয় সংসদ ভবন এলাকার সাবজেলে। সেখানে প্রথমে তাকে সংবাদপত্র ও টেলিভিশন থেকেও দূরে রাখা হয়েছিল, এমনি দেখা করতে দেওয়া হয়নি স্বজন-নেতাকর্মী বা আইনজীবীর সঙ্গেও। এই আচরণকে দেশবাসী অভিহিত করে- একাকী নির্জনে নিঃসঙ্গ করে তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র হিসেবে। পরে দলীয় কর্মীদের দাবির মুখে তাকে সংবাদ দেখার অনুমতি দেওয়া হয়।
জননেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের পর থেকেই দেশজুড়ে প্রতিদিনই আন্দোলন-সংগ্রাম-প্রতিবাদ চলতে থাকে। ২৪ জুলাই মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের সামনে শেখ হাসিনার মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ হয়। সেই বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন তার পুত্র ও বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। এসময় আন্তর্জাতিকভাবেও এই গ্রেফতারের প্রতিবাদ জানায় কানাডা-অষ্ট্রেলিয়া-ব্রিটেনসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র।
এদিকে জেলে বন্দি অবস্থায় শেখ হাসিনার সঙ্গে দীর্ঘদিন স্বজনদের সাক্ষাৎ বন্ধ রাখা হয়। ফলে তার চিকিৎসা প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। গ্রেনেড হামলায় আহত কান ও চোখ চিকিৎসার অভাবে আরো ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। মানসিকভাবে শক্ত থাকলেও, শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তাকে স্লো-পয়জনিং করা হচ্ছে বলেও আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে ঘটতে, অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছালেও তার জন্য ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়নি। এরকম পরিস্থিতিতে, ২০০৮ সালের ৩১ মার্চ, আদালতে হাজিরা দিতে নেওয়া হলে আইনজীবীদের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু পারেনি। এখন বিনা চিকিৎসায় মারার চেষ্টা করছে।’
এসময় শেখ হাসিনা আরো বলেন, ‘১৯৭১ সালে সন্তানসম্ভবা ছিলাম। পাকিস্তানিরা মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন কারো সাথে দেখা করতে দেয়নি। এখন এরা চিকিৎসাসেবা ও আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে দিচ্ছে না। আমার ওপর যে অবিচার করা হয়েছে, তার ভার আমি আল্লাহ ও জনগণের ওপর দিচ্ছি।’
জেলে তাকে সঠিক চিকিৎসা না দেওয়ায়, একপর্যায়ে তার অসুস্থতা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে চলে যায়। অবশেষে তাকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানকার চিকিৎসকরা টানা ২০ দিন চিকিৎসার পর তাকে আপাত স্বাভাবিক করে তোলেন এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার পরামর্শ দেন।
জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও দেশ ও জনতার কথা ভুলে যাননি নেত্রী। ২০০৭ সালের জুলাই মাসে, তাকে যখন নির্জন কারাগারে ঢুকিয়ে মৃত্যুর ভয় দেখানো হচ্ছিলো, ঠিক তখনই, আগস্ট মাসে দেশজুড়ে তখন চলছিল ভয়াবহ বন্যা। গণমাধ্যমে এই খবর দেখে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য নেতাকর্মীদের প্রতি নির্দেশনা পাঠান তিনি। এমনকি সেই বছরের নভেম্বরে যখন সিডরের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় উপকূলবর্তী দেশের এক তৃতীয়াংশ অঞ্চল, তখনও দলমত নির্বিশেষে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আওয়ামী লীগের প্রতি নির্দেশ দেন তিনি।
পরবর্তীতে, সরকারের অব্যবস্থাপনার কারণে, দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি চরমে উঠলে, উষ্মা প্রকাশ করেন তিনি। ২০০৮ সালের মে মাসে আদালতে আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলার সময় দেশের মানুষের জীবন ও জীবিকা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন জননেত্রী। একইসঙ্গে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করবে বলেও আশা প্রকাশ করেন।