বিশটা স্নাতক ডিগ্রীধারী এক অমিত প্রতিভাবানের গল্প!
বিশটা স্নাতক ডিগ্রীধারী এক অমিত প্রতিভাবানের গল্প!
নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত আগস্ট ২২, ২০১৯
পড়তে কার ভালো লাগে? গল্প-উপন্যাসের বইয়ের কথা বলছি না, বলা হচ্ছে পাঠ্যবইয়ের রসকষহীন পড়ালেখার কথা। টানা আধঘন্টা এসবের সামনে বসেই আমরা হাঁপিয়ে উঠি, দমবন্ধ হয়ে আসে। একটু ফেসবুকে ঢুঁ না মারলে, একটা দুটো স্ট্যাটাস না দিলে কিংবা মেসেঞ্জারটা চেক না করলে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়। পড়ালেখার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা সাপে-নেউলের। এমনি এমনি তো আর ‘মন বসে না পড়ার টেবিলে’ নামের সিনেমা বানানো হয়নি! তবে আজ একজন মানুষের গল্প শোনাবো, যার সারাটা জীবন কেটেছে পড়তে পড়তে। আমরা দু-চারটে পরীক্ষা দিয়ে হাঁপিয়ে উঠি, কোনমতে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করতে পারলে পড়ালেখাকে টাটা বাইবাই জানিয়ে দেই, আর এই মানুষটা নামের পাশে লাগিয়েছেন বিশটা ডিগ্রী!
নাম তাঁর শ্রীকান্ত জিকচার। ১৯৫৪ সালে ভারতের নাগপুরে এক মারাঠি পরিবারে জন্ম। ছোটবেলা থেকেই দারুণ কৌতুহলী মন তাঁর, আগ্রহ ছিল ছবি আঁকায়, ভালোবাসতেন খেলাধুলাও, রাজনীতি, বিজ্ঞান, সাংবাদিকতা, শিল্পকলা সবকিছু নিয়েই তাঁর আগ্রহ ছিল আকাশচুম্বী। শিক্ষাজীবনের শুরুটা হলো ডাক্তারী দিয়ে, এমবিবিএস পাশ করার পর মেডিসিনের ওপর পোস্টগ্র্যাজুয়েশন করলেন। বাড়ীর লোকেরা ভাবলো, এবার বুঝি ডাক্তারীতে মন দেবে ছেলে। কোথায় কী! জিকচার শুরু করলেন এলএলবিতে পড়া, সেইসঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল ল’ এর ওপর স্নাতকোত্তর করলেন। এবার মন চাইলো ব্যাবসাটা বুঝবেন, শুরু করলেন বিজনেস ম্যানেজমেন্টের ওপর ডিপ্লোমা। এরপর এমবিএ ডিগ্রীও বাগিয়ে নিলেন। এরপর ছোটবেলার পছন্দের বিষয় সাংবাদিকতায় স্নাতক পাশ করলেন। পাঠক, কি ভাবছেন? এবার ক্ষান্ত দেবেন জিকচার? উহু, তিনি তো আপনার আমার মতো সাধারণ কেউ নন!
এই ভদ্রলোক স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নিয়েছেন দশটি বিষয়ে, লোকপ্রশাসন, অর্থনীতি, সংস্কৃত(ডি. লিট), ইতিহাস, ইংরেজী, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, প্রাচীন ভারতের ইতিহাস, সংকৃতি ও পূরাকীর্তি এবং মনোবিজ্ঞানের ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রী আছে তাঁর, এবং প্রতিটিতেই প্রথম শ্রেণী পেয়েছিলেন তিনি। এলিয়েন বা ভূত-প্রেত নন, তিনি রক্ত মাংসে গড়া একজন মানুষই। শিক্ষাক্ষেত্রে কৃতিত্বের নিদর্শনস্বরূপ আটাশটি স্বর্ণপদকও আছে তাঁর ঝুলিতে। কি ভাবছেন? কয় বছর সময় লেগেছে এসবে? চার-পাঁচ বছর নয়, ১৯৭৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত প্রতিটি গ্রীষ্ম বা শীতেই তিনি কোন না কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক/স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দিয়ে গেছেন। সময়ের অভাবে কোথাও হয়তো পরীক্ষা দিতে না পেরে অকৃতকার্যও হয়েছেন। মোট ৪২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়ে তিনি ডিগ্রী অর্জন করেছিলেন বিশটি।
পড়তে পড়তে বিরক্ত হয়ে গেলে আমরা কি করি? এখন তো ডিজিটাল যুগ, ফেসবুকেই ঢু মারা হয় বেশী। জিকচারও খানিকটা বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন বোধহয়। তখন তো আর স্মার্টফোন ছিল না, ছিল না ফেসবুকও। জিকচার সময় কাটাতে পরীক্ষা দিলেন আইপিএস’এ। কৃতকার্যও হলেন। কিন্ত চাকুরীতে মন বসলো না, সেটা ছেড়ে ভারতের সিভিল সার্ভিসে প্রবেশের জন্যে আইএএস পরিক্ষায় বসলেন। জিকচারকে ঠেকায় কে! সেখানেও তিনি পাশ, কিন্ত এই চাকরী ছাড়লেন মাত্র চার মাসের মাথায়!
আইএএসের চাকুরীটা ছেড়েছিলেন মূলত রাজনীতির ময়দানে ঢুঁ মেরে দেখবেন বলে। ১৯৮০ সালেই মহারাষ্ট্রের বিধানসভার ভোটের লড়াইতে নামলেন জিকচার। এত এত কঠিন বিদ্যাই যাকে ঠেকাতে পারেনি, অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত বিরোধী প্রার্থীরা তাঁকে আর কি করে ঠেকাবেন! সে বছর জিকচার যখন বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হলেন, তাঁর বয়স তখ পঁচিশ আর ছাব্বিশের মাঝামাঝিতে অবস্থান করছে! উনিই ছিলেন ভারতের সবচেয়ে কমবয়েসী বিধায়ক। মন্ত্রীত্বও পেলেন, তাই একটা নয় দুইটা নয়, একসঙ্গে চৌদ্দটা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেলেন শ্রীকান্ত জিকচার! ১৯৯২ সালে নির্বাচিত হলেন রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে।
এত কিছুতেই তাঁর কৃতিত্ব শেষ নয়। ছিলেন শখের ফটোগ্রাফার। দারুণ ছবি আঁকতে পারতেন। থিয়েটারেও অভিনয় করতেন। সেই সময়ে ভারতের অন্যতম বিখ্যাত পুরোহিত ছিলেন তিনি, অগ্নিহোত্রী গোত্রের ব্রাক্ষ্মণ হিসেবে তিন ধরনের যজ্ঞ পালন করতেন বলে জানা যায়। জ্যোতিষশাস্ত্রেও দারুণ দখল ছিল তাঁর, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ ও ইউনেস্কোতে ভারতের প্রতিনিধিত্বও করেছেন তিনি। সময় নেই অসময় নেই, প্রায় প্রতিটা মূহুর্তই তাঁর কাটতো বই পড়ে। অজানাকে জানার নেশায় চাতক পাখি হয়ে থাকা এই মানুষটার সংগ্রহে ছিল প্রায় ৫২০০০ বইয়ের এক বিশাল ভাণ্ডার! ‘লিমকা বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’ তাঁকে ভারতবর্ষের সবচেয়ে শিক্ষিত ব্যক্তির স্বীকৃতি দিয়েছিল। ১৯৮৩ সালে ভারতের প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপ জেতার বছরেই তিনি ‘বিশ্বের অসামান্য দশজন তরুণ’-এর একজন নির্বাচিত হন।
অসম্ভব প্রতিভাবান এবং সৃষ্টিশীল এই মানুষটি না ফেরার দেশে চলে গিয়েছিলেন ২০০৪ সালের ২রা জুন। স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি তাঁর, নিজ শহর নাগপুরেই এক সড়ক দূর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা যান তিনি। এখনও নাগপুরের মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে তাঁর নাম, তাঁর বিশাল বইয়ের সংগ্রহশালা নিয়ে খোলা হয়েছে লাইব্রেরী, সেটাও তাঁর নামেই। শ্রীকান্ত জিকচার, জ্ঞানপাগল সেই মানুষটা, নিজের কীর্তিতেই যিনি অনন্য হয়ে থাকবেন সারাজীবন।
অসম্ভব প্রতিভাবান এবং সৃষ্টিশীল এই মানুষটি না ফেরার দেশে চলে গিয়েছিলেন ২০০৪ সালের ২রা জুন। স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি তাঁর, নিজ শহর নাগপুরেই এক সড়ক দূর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা যান তিনি। এখনও নাগপুরের মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে তাঁর নাম, তাঁর বিশাল বইয়ের সংগ্রহশালা নিয়ে খোলা হয়েছে লাইব্রেরী, সেটাও তাঁর নামেই। শ্রীকান্ত জিকচার, জ্ঞানপাগল সেই মানুষটা, নিজের কীর্তিতেই যিনি অনন্য হয়ে থাকবেন সারাজীবন।