ঢাবিতে নিজেদেরকে রাজাকার বলে স্লোগান দেয়ার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ করায় অবিলম্বে রাজাকার শ্লোগানধারীদের ছাত্রত্ব বাতিলসহ গ্রেফতারের দাবিতে আজ ১৫ জুলাই সোমবার বিকাল ৩টায় শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে মানববন্ধন শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচী পালন করেছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। উক্ত কর্মসূচীতে বক্তব্য রাখেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের সভাপতি মাহবুবুল ইসলাম প্রিন্স, মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল, সাধারণ সম্পাদক আল মামুন, অপরাজেয় বাংলার সদস্য সচিব এইচ রহমান মিলু, অধ্যাপক ডাঃ উত্তম কুমার বড়ূয়া, ঢাবি অধ্যাপক ড. আকম জামাল উদ্দিন, ঢাবি শিক্ষার্থী কানিজ ফাতেমা, অভিজিৎ সরকারসহ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।
বিক্ষোভ সমাবেশের বক্তব্যে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন বলেন, “গতকাল মহান মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তুমি কে আমি কে, রাজাকার-রাজাকার স্লোগান দেওয়ার মাধ্যমে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতি চরম অসম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে। এধরনের স্লোগানধারীদেরকে অবিলম্বে শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি। নিজেকে রাজাকার, রাজাকার স্লোগান দেয়ার অর্থ হচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা রাজাকার হিসেবে কাজ করেছে তাদের পক্ষে দাঁড়ানো এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশের শামিল। এই ধরনের কার্যকলাপ রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। কারণ এটি জাতির সংহতি এবং মূল্যবোধের ওপর আঘাত হানে। বাংলাদেশের সংবিধান ও আইন অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি এবং রাজাকারদের সমর্থনকারী কার্যকলাপ আইনত অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। এজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, সরকার ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলির উচিত এই ধরনের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং জাতীয় সংহতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি, বেশ কিছুদিন যাবত কোটা বিরোধী আন্দোলনের নামে একাত্তরের পরাজিত শক্তির প্রেতাত্মা গোষ্ঠী মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৩০ লাখ শহীদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদেরকে পরিবারকে নানা ভাবে অপমান অপদস্থ করা হচ্ছে। বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নজরে এলে তিনিও এ বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার বক্তব্য অত্যন্ত যৌক্তিক ও সময়োপযোগী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে খণ্ডিত আকারে অপপ্রচার চালিয়ে স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি ছাত্রদল-শিবির নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের অপচেষ্টা চালাচ্ছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত জায়গায় থেকে রাতের আধারে পরিত্যক্ত ও প্রত্যাখ্যাত রাজনৈতিক গোষ্ঠী শিবির-ছাত্রদলের ছত্রচ্ছায়ায় কতিপয় বিভ্রান্ত শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ বিরোধী বালখিল্য কর্মকাণ্ড এবং রাজাকার রাজাকার স্লোগান দেয়া আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। এরা সময়ে অসময়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপন করে জাতিকে বিভক্ত করছে। ঐতিহাসিক ভাবে মীমাংসিত বিষয়কে অমিমাংসিত করার চেষ্টা করছে। এখানে আমরা দেশের বিরুদ্ধে রাজাকারদের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র দেখতে পাচ্ছি। রাজাকারদের তালিকা প্রণয়ন করে এদের পরবর্তী প্রজন্মকে সরকারি ও বেসরকারি সকল চাকুরীতে নিষিদ্ধ করা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। অবিলম্বে রাজাকার শ্লোগানধারীদেরকে চিহ্নিত করে ছাত্রত্ব বাতিলসহ গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। মেধা কোটার নাম পরিবর্তন করে সাধারণ কোটা নামে সংজ্ঞায়িত করা প্রয়োজন। কারণ কোটায় নিয়োগপ্রাপ্তরা কখনোই অমেধাবী নয়। তারাও মেধাবী। তাদেরকেও প্রিলি, লিখিত ও ভাইভায় পাশ করার পর কোটা সুবিধা পেতে হয়। বৈষম্যমূলক মেধা শব্দ পরিবর্তন করে সাধারণ শব্দ সংযোজন করে সকল নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হবে। মহামান্য হাইকোর্ট কর্তৃক সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের ২০১৮ সালের অবৈধ পরিপত্র বাতিলের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তকে এদেশের তরুণ সমাজ স্বাগত জানিয়েছে। উচ্চ আদালতের প্রতি আমাদের পূর্ণাঙ্গ আস্থা রয়েছে। আমাদের বিশ্বাস করি, বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবাররা সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগে ন্যায়বিচার পাবেন। ইতিমধ্যে আপীল বিভাগে চার সপ্তাহের স্টে অর্ডার দেয়া হয়েছে। আমরা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। চূড়ান্ত শুনানির জন্য অপেক্ষা করছি। আদালতে আইনী লড়াই চালানোর পাশাপাশি ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল ও রাজাকারদের তালিকা প্রকাশসহ এদের তিন প্রজন্মকে সরকারি চাকরিতে নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাজপথে সক্রিয় থাকবো।”
সংগঠনের সভাপতি মাহবুবুল ইসলাম প্রিন্স বলেন, “মহান মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় মেয়ে যখন রাজাকার, রাজাকার বলে শ্লোগান দিচ্ছে ঠিক তখনি আমার মনসপটে ভেসে ওঠে ১৮ বছরের জনৈকা রূপবতী ছাত্রীর উলঙ্গ লাশ, পঁচা-ফোলা রূপসীর উলঙ্গ দেহ, ডাগর ডাগর চোখ ফুলে বের হয়ে আছে, মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে, লজ্জাস্থান পেট থেকে ফুলে অনেকটা উপরে উঠে আছে, স্ত্রীজননেন্দ্রিয় রক্তাক্ত। তার দুই দিকের গালে পশুদের কামড়ের চিহ্ন, বক্ষোজে মানুষের দাঁতের দংশনের চিহ্ন। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলে আছে- সিলিং ফ্যানে ৬টি মেয়ের পা-বাঁধা নগ্ন মৃতদেহ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিলো। ঢাকার তখনকার কাউন্সিল জেনারেল আর্চার কে ব্লাডের ‘দি ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ’ থেকে জানা যায়, ছাত্রীনিবাস রোকেয়া হলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল। পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সঙ্গে আর্মি ইউনিট ৮৮-এর কথোপকথন থেকে জানা যায়, আনুমানিক ৩০০ জন ছাত্রীকে সে সময় হত্যা করা হয়।
রফিকুল ইসলামের ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ থেকে জানা যায়- ১৯৭১ সালের ১০ই নভেম্বর গভীর রাতে রোকেয়া হলে সশস্ত্র পাকিস্তনী সৈন্য রাজাকারের সহযোগিতায় প্রবেশ করে এবং হলে অবস্থানকারী মোট ত্রিশজন ছাত্রীর ওপর নির্যাতন চালায়, সর্বস্বহরণ করে! আমাদের ছাত্রীবোনেরা কি জানে এই চিত্র ছিলো ১৯৭১ সালের ২৫মার্চের সেই কালো রাতের কথা। নিজেদের রাজাকার বলে পরিচয় দিতে এসব ছেলে-মেয়েদের লজ্জা হয় না?”
মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল বলেন, “এই রাজাকাররা যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে মিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭১ সালে ২৫ শে মার্চ গণহত্যা চালিয়েছিল, যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের রাজাকারদের সহায়তায় হত্যা করা হয়েছিল, ধর্ষিত হয়েছিলো রোকেয়া হলে ছাত্রীবোনেরা সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছেলেমেয়েরা নিজেদেরকে রাজাকার বলে স্লোগান দেয়। কতোটা দেশদ্রোহী ও বেহায়া হলে এরা এধরণের ন্যাক্কারজনক শ্লোগান দিতে পারে। এদেরকে চিহ্নিত করে ছাত্রত্ব বাতিল করে আইনের আওতায় আনতে হবে।”
অপরাজেয় বাংলার সদস্য-সচিব এইচ রহমান মিলু বলেন, “কোটা বাতিল আন্দোলনের নামে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে কটূক্তিকারী রাজাকারের বংশধরদের ছাত্রত্ব বাতিল করে দ্রুত গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ করে নাগরিকত্ব বাতিলসহ ওদের বংশধরদের রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা বাতিল ও তিন প্রজন্মকে সরকারি চাকরিতে নিষিদ্ধ করতে হবে। অন্যথায় আমরা দেশব্যাপী কঠোর কর্মসূচী ঘোষণা করবো।”
অধ্যাপক ডাঃ উত্তম কুমার বড়ূয়া বলেন, “আমাদের পূর্বসূরীরা বাঙ্গালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে দেশমাতৃকার জন্য নিজের জীবন ও যৌবন উৎসর্গ করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার দৃঢ প্রত্যয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ও সংবিধান প্রাপ্তির আশায় বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছেন। আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ চিন্তা ও লক্ষ্যের উত্তরসূরী বিধায় বাংলাদেশের ভবিষ্যতেরও উত্তরসূরী। আমরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে টিকিয়ে রাখতে, বাংলাদেশের আইন ও সমাজ ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে এবং সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও উত্তরসূরীদের বাংলাদেশের সরকারি চাকুরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ কোটা সংরক্ষণ ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা আবশ্যক। স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকারদের আস্ফালন আর সহ্য করা হবে না। এদেরকে সমূলে উৎপাটন করতে হবে।”
ঢাবি শাখা মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কানিজ ফাতেমা বলেন, “বৈষম্য দূর করার জন্য নারী কোটার অবশ্যই প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু মেয়ে না বুঝে নারী কোটার বিরোধিতা করে নিজেদের সুযোগ হারাচ্ছেন। বিগত বিসিএসে নারী কোটা না থাকার কারণে ছেলেরা সব ভালো ক্যাডার নিয়ে গেছেন। কিছু নারী শিক্ষা বা অন্য ক্যাডার হতে পারলেও সেটার সংখ্যা পূর্বের তুলনায় সামান্য। নারী কোটা না থাকার কারণে ঢাবির বাহিরের বিশ্ববিদ্যালয়ের নারীরা আরো বঞ্চিত হচ্ছেন। বিগত বিসিএসে তাদের সংখ্যা নেই বললেই চলে। ১০ শতাংশ নারী কোটা থাকা অবস্থায় বিসিএসে প্রতিটি ক্যাডারে শতকরা ১০ জন করে নারী নিশ্চিত তাদের কাঙ্ক্ষিত ক্যাডার পেয়ে যেতেন। নারী উচ্চ শিক্ষা ও অগ্রগতি বিরোধী মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী জামাত-শিবিরের ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দিয়ে নিজেদের ক্ষতি ডেকে আনবেন না। কারণ জামাত-শিবিরের পরিকল্পনা হচ্ছে নারীদেরকে চাকরি থেকে বঞ্চিত করে গৃহদাসী করে রেখে বাংলাদেশকে পিছিয়ে দেয়া। এজন্যই জামাত-বিএনপি রাজনৈতিক মাঠে ব্যর্থ হয়ে এখন কোটা ব্যবস্থা সম্পর্কে অপপ্রচার ও গুজব ছড়িয়ে শিক্ষার্থীদের আবেগকে ব্যবহার করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা চালাচ্ছে। নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সকল কোটা পুনর্বহালের কোন বিকল্প নেই।”