হিপ্পিদের নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাদের চলে যেতে হবে সেই ষাটের দশকের দিকে। যে সময়টাকে বলা হয় যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি কালো অধ্যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দা, ভিয়েতনাম যুদ্ধসহ নানা কারণে তখনকার সাধারণ মানুষ বিশেষ করে যুবক সম্প্রদায় হতাশ হয়ে পড়ে। অসংখ্য শিক্ষিত যুবক বেকার জীবনযাপন করতে থাকে। তখন ব্রিটেনের উচ্চবিত্ত তরুণদের মাঝে একটা নতুন হাইপ তৈরি হলো। সেটা হল পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে-পরিবার-আয়-রোজগার করার আগে একবার চারদিকটা ঘুরে দেখার ইচ্ছা। তারা তখনকার নতুন ক্রেজ ল্যান্ডরোভারে করে রওনা দিত পুবে, মরুভূমি, পাহাড়, আর নানা রকম এডভেঞ্চার করত। আবার বিভিন্ন রকম বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালাবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তরুণরা যেত বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে এশিয়ার এমন সব জায়গায় যেখানে আগে খুব কম ইউরোপিয়ানরাই গিয়েছে। তারা যখন ফিরে আসত, তাদের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা আর গল্প বিভিন্নভাবেই সব স্তরের এডভেঞ্চার পাগল তরুণদের মাঝে সাড়া জাগাত।
এছাড়াও ইউরোপের তরুণদের মাঝে ভারতের প্রতি একটা মোহ কাজ করত। ভারত তখন ইউরোপের মানুষদের কাছে রহস্যময় আর জাদুকরী একটা জায়গা। যেখানে সাধুরা পানিতে হেঁটে বেড়ায়, তন্ত্র সাধনা করে, মরাকে জীবিত করে, শূন্যে ভেসে থাকে এরকম অদ্ভুত রকম একটা রোমান্টিসিজম চালু হয়েছিল ভারতের বিষয়ে। দৈনন্দিন জীবনে বিরক্ত তরুণরা তাই অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে উঠে ভারতের বিষয়ে। পরিচিত গন্ডি ছাড়িয়ে তারা ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম – মফস্বলে। এই তরুণরাই একসময় ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের আরাধক হয়ে ওঠে। নিজেদের তারা বলতে শুরু করে, আই অ্যাম হিপ্পি!
৬০ – এর দশকের দিকেই ব্যাপক উত্থান ঘটে ‘হিপ্পি’দের এবং সেই সাথে শুরু হয় হিপ্পিদের নিয়ে মানুষের ভ্রান্ত ধারণা। যেমন সেই সময়ের অনেকেই মনে করে, ঠিক–ঠাক মতো গোসল না করা, জামার বোতাম খুলে উসকো–শুস্ককো চুল আর দাঁড়ি না কাটাই হচ্ছে হিপ্পি কালচার – বাস্তবে কিন্তু তা নয়। মূলত হিপ্পি ঘরানার জন্ম চলমান ব্যবস্থাকে “না” বলে দেয়া। এটা আসলে Counter-culture থেকেই এসেছে – অর্থাৎ যারা বিদ্যমান সংস্কৃতি, সামাজিক আচার–আচরণের বিপক্ষে ছিলেন। আধ্যাত্মিকতা আর স্বজ্ঞাকে অবলম্বন করে আবর্তিত হতে থাকে তাদের চিন্তা চেতনা।
হিপ্পি সংস্কৃতি থেকে জন্ম নিয়েছিল ব্রাদার অব ইটারনাল লাভ। তাদের লক্ষ্য ছিল বৈশ্বিক, তবে শেষ পর্যন্ত তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এই আন্দোলনটি ছিল ইভানজেলিক সম্প্রদায়ের একটি অংশের পরিচালিত। তারা নিজেদের আধ্যাত্মিকতার পর্যায়ে নিয়ে যেতে এলএসডি সেবন করতো। এই এলএসডির মধ্যে থাকে সিলোসিবিন নামের একটি পদার্থ, যা সেবনকারীকে ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতার এক অনুভূতি দেয়। এজন্য একটি আলাদা একটি প্রার্থনাগৃহও তৈরি করেছিল ব্রাদারহুড সদস্যরা। তারা দাবি করতো, এলএসডি সেবন করলে তাদের অনুভূতি আরো তীব্র হয়। বিভিন্ন রঙ আরো স্পষ্টভাবে চোখে ধরা পড়ে। একটি কল্পরাষ্ট্র বা ইউটোপিয়ার স্বপ্ন ছিল তাদের, যেখানে কোনো আইন-কানুন থাকবে না, প্রত্যেকে নিজের মতো করে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে পারবে।
সাংস্কৃতিক জগতের দিকে তাকালে দেখা যাবে সমাজ বদলের চিন্তা থেকে অনেকেই এগিয়ে এসেছিলেন আলাদা আলাদাভাবে কিংবা একযোগে, সম্মিলিতভাবে। যেমন বব ডিলান, জন লেননদের কথাই যদি ধরা যায় তাহলে দেখা যাবে, এরাও বিদ্যমান ব্যবস্থার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। তারা সমাজতন্ত্রী না হয়েও একটি ন্যায়ানুগ সমাজ কামনা করতেন, যুদ্ধের বিরোধীতা করতেন। তারা মনে করতেন মনে–প্রাণে – যুদ্ধ ধ্বংসই করে, ধ্বংস ডেকে নিয়ে আসে – মানব সমাজের উন্নয়ন বা কল্যাণ করে না। পিট সিগারও তো জনমানুষের গান গাইতেন। তিনি গাইতেন উই শ্যাল ওভার কামসহ নানা গান, যা উদ্দীপ্ত করতো মানুষকে, প্রগতির স্বপক্ষের জনগোষ্ঠীকে। এ রকম অনেকেই ছিলেন।
কিন্তু জীবনের বাস্তবতা হলো যার শুরু আছে, তার শেষও আছে এবং হিপ্পিদের দিনও ঘনিয়ে এলো এক সময়। সময়টা তখন ১৯৭৯। আমেরিকাতে হিপ্পিদের আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়তে শুরু করে। হিপ্পিরা বিভিন্ন যেসব জায়গা থেকে অর্থ এবং অন্যান্য সহযোগিতা পেয়ে আসছিল, সেগুলোও কমে আসতে থাকে। শুধুমাত্র নাচ, গান, মাদক, ফুর্তি করে দিন কাটানো কঠিন হয়ে উঠতে থাকে। এভাবে অল্প কিছু পরিমাণ মানুষ থেকে যায়, বাকিরা কয়েকবছর একটা বেশ এডভেঞ্চার করা গেছে এরকম মনোভাব নিয়ে ফিরে যেতে থাকে তাদের নিয়মিত জীবনে।
এক অর্থে বলা যায়, হিপ্পি লাইফ-স্টাইল হারিয়ে যেতে থাকে কারণ সেটা ইতোমধ্যেই প্রায় বিশ বছরের পুরাতন একটা কালচারে পরিণত হয়েছিল, নতুন ধরনের স্টাইল আসছিল যেটাতে মানুষ বেশি করে আকৃষ্ট হচ্ছিল, অর্থনৈতিক কারণে কল-কারখানাগুলোতে বেশি বেশি মানুষ দরকার হচ্ছিল, আর হিপ্পি জীবন যাপনের মূল আকর্ষণ মাদক বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা আরও বেশি কড়া হয়ে উঠছিল দিনকে দিন।
আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার বাস কোম্পানিগুলো কিছুদিন পরে অন্য রুটে চলাচল করতে শুরু করে। যেসব হোস্টেল এক সময় আমেরিকান এবং ইউরোপিয়ান দিয়ে ভরা থাকত, সেগুলো খালি হয়ে উঠতে থাকে। হিপ্পিদের বিখ্যাত সব জায়গাগুলো একসময় স্মৃতি আর আত্মজীবনীতেই বেঁচে থাকতে শুরু করে। এভাবেই শেষ হয়ে যায় হিপ্পি নামের একটি কালচার, একটি আন্দোলন, একটি লাইফ স্টাইল।
তথ্যসুত্রঃ Bisk Club, Wikipedia