• ৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ৫ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

মৃত্যুর ভয় নয়, মৃত্যুর প্রস্তুতি : আশুক আহমদ

নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত অক্টোবর ১৩, ২০২০
মৃত্যুর ভয় নয়, মৃত্যুর প্রস্তুতি : আশুক আহমদ

মানব শিশু জন্মের সাথে সাথে তার পরপারে যাওয়ার ক্ষণগণনা শুরু হয়ে যায়। সবাইকে মৃত্যুদূতের সাথে সাক্ষাৎ করতেই হয়, এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। আল্লাহ বলেন, “প্রত্যেককে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। আমি তোমাদেরকে মন্দ ও ভাল দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি এবং আমারই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।” মৃত্যুর হাত থেকে পালানোর উপায় বা সুযোগ নেই। পবিত্র কুরআনে এ ব্যাপারে বলা হয়েছে, “তোমরা যেখানেই থাক না কেন; মৃত্যু কিন্তু তোমাদেরকে পাকড়াও করবেই। যদি তোমরা সুদৃঢ় দূর্গের ভেতরেও অবস্থান কর তবুও।” মরণের সময় চলে আসলে আর একটি মুহূর্ত দেরি করা হবে না। আল্লাহ্তায়ালা সূরা ইউনূসের ৪৯নং আয়াতে ইরশাদ করেন, ‘যখন মৃত্যুর সময় এসে যাবে, তখন এক মুহূর্ত এদিক সেদিক করা যাবে না; সঙ্গে সঙ্গে চলে যেতে হবে।’ দুনিয়ার ধন-সম্পদের লোভ, সৌন্দর্য, প্রভাব-প্রতিপত্তি, যশ-খ্যাতি  আর ক্ষমতার মোহ আমাদের আখেরাত বিমুখ করে রেখেছে। আমাদের পূর্ণ জীবন-যৌবন, শক্তি-সামর্থ্য সব অস্থায়ী দুনিয়ার পেছনে ব্যয় করে যাচ্ছি, কদাচিৎ আখেরাতের স্থায়ী জীবনের  কথা চিন্তা করছি । 

মানব জীবনের দুটি স্তর- একটি ইহলৌকিক অর্থাৎ দুনিয়ার জীবন যা একেবারেই ক্ষণস্থায়ী, অপরটি পারলৌকিক বা মৃত্যু পরবর্তী আখেরাতের জীবন  যা অনন্তকালব্যাপী। আমাদের জীবনের ইহলৌকিক পরিণতি হচ্ছে মৃত্যু যার মাধ্যমে আমাদের পরকালীন জীবনের সূচনা হয়। এই পরকালেই দুনিয়ার ক্ষনস্থায়ী  জীবনে যে যা করে গেছে তার চুলচেরা হিসাব নিকাশ করে আল্লাহ  অনন্তকালের জন্য জান্নাত বা জাহান্নামে ঠাই দিবেন। মেরাজের রাতে আল্লাহ্তায়ালা হজরত রসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখিয়েছেন মরণের পরের ধাপগুলি  গোনাহগারদের কিভাবে পাড়ি দিতে হবে আর কোন অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে। দুনিয়ায় যারা আল্লাহর আদেশ নিষেধ মেনে নবী করীম (সা) এর দেখানো পথে জীবন যাপন করেছেন তাদের সাথে কেমন ব্যবহার করা হবে আর তাদের স্থান কোথায় হবে তা দেখানো হয়েছে। 

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন উম্মতের সবচেয়ে বড় দরদী ও শুভাকাঙ্ক্ষী, উম্মতের মুক্তি কামনাই ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় তপস্যা। উম্মতের শান্তির জন্য তিনি আল্লাহর দরবারে অনেক আবেদন-নিবেদন করেছেন। কিন্তু  আমরা হানাহানি, প্রতারণা, খুন-খারাবি, দুর্নীতি, আমোদ-আহ্লাদ, ভোগ-বিলাস, সুখ-শান্তিতে আত্মহারা হয়ে এই দুনিয়ায় থাকছি, খাচ্ছি; সবকিছু মনের মতো উপভোগ করছি। অনন্তকাল ধরে যে জায়গায় থাকতে হবে- আখেরাতের জীবন; তার কথা কে কতটা ভাবছি?  

প্রত্যেক বিশ্বাসীর মৃত্যুর কথা অর্থাৎ আখেরাতের কথা চিন্তা-চেতনা ও অন্তরে জাগরূক থাকা আবশ্যক  এবং এটিই সত্যিকারের নেক বান্দার কাজ। যারা এ কাজ করতে পারে সত্যিই তারা 

জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান। এ সম্পর্কে আল্লাহর  রাসুল (সা) বলেছেন, যে বা যারা স্বীয় কামনা-বাসনা ও স্বীয় নফ্সকে বশীভূত করতে সমর্থ হয়েছে, তারাই সত্যিকারের ইমানদার বুদ্ধিমান। কেউ অধিক সময় আখেরাতের (পরকাল) চিন্তায় থাকলে কখনও ইহজীবনে অপকর্মে লিপ্ত হতে পারে না।  সত্যিকারের আল্লাহভীরু  আখেরাতের সংগ্রহ নামাজ-কালাম, ইবাদত-বন্দেগি আমলে ছালেহে লিপ্ত থাকে। আল্লাহপাক বলেছেন, যে বা যারা আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনকে আপন করে নেয় এবং সীমাতিরিক্ত ভালোবাসে এবং আল্লাহর পথ থেকে এড়িয়ে চলে, ফাঁকফোকর খুঁজে ফেরে, এরাই সেই দল যারা প্রতিনিয়ত গোমরাহি, পথভ্রষ্টের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। কাজেই আমাদের প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস যেন আল্লাহপাকের জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিলের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করি। আমরা যেন পার্থিব জগতের মোহ-মায়াজালে পড়ে, ঘর-সংসার, পরিবার-পরিজন, অর্থ-সম্পদ নিয়ে বিভোর না থাকি সেজন্য 

আল্লাহপাক ও রাসুলে করিমের (সা) বারংবার হুঁশিয়ার করেছেন।

 কয়েকটি চোখের পলকের নাম জীবন। তাই আল্লাহর আদেশ নিষেধ মেনে  সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে মুমিন মৃত্যু ও মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের জন্য প্রস্তুতি নেবে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা পাঁচ জিনিসকে পাঁচ জিনিসের আগে গনিমত (সম্পদ) মনে করো: ১. যৌবনকে বার্ধক্যের আগে, ২. সুস্থতাকে অসুস্থতার আগে, ৩. সচ্ছলতাকে অভাবের আগে, ৪. অবসরকে ব্যস্ততার আগে, ৫. জীবনকে মৃত্যু আসার আগে। 

মৃত্যুকে ভয় না করে মৃত্যুর স্মরণ ও পরবর্তী জীবনের পরিণতি চিন্তা করতে ইসলাম উদ্বুদ্ধ করেছে।  মহানবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা জীবনের স্বাদ ধ্বংসকারী (মৃত্যু)-কে বেশি পরিমাণে স্মরণ করো।’ মানুষের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি প্রাণীর প্রতিটি মুহূর্ত যেন তার মৃত্যুর মুহূর্ত। নবীজী (সা) আরও  বলেছেন, কবর জিয়ারত কর, তাতে আখেরাতের কথা মনে হবে। কারণ, সেখানে তোমার পিতা-মাতা, বন্ধু-বান্ধব এবং অল্প বয়সের শিশুও শুয়ে আছে। ছোট-বড় নির্বিশেষে সবাইকে একদিন অবশ্যই কবরে যেতে হবে। সেখানে যাওয়ার সুনির্দিষ্ট সময়টি কারও জানা নেই।  মৃত্যু কাউকে সংবাদ দিয়ে আসবে না যে, হে ব্যক্তি! তুমি সাবধান হয়ে যাও। মৃত্যু তোমার কাছে অমুক দিন এতটার সময় আসবে? না, এমনটি কখনো হবে না। ছোট-বড় ভালো-মন্দ, সুস্থ-অসুস্থের কোনো ভেদাভেদ নেই। তুমি যেখানেই থাক না কেন, সময় আসার সঙ্গে সঙ্গে তোমার ইচ্ছা-অনিচ্ছায় তোমাকে চলেই যেতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। অতএব, মৃত্যুকে স্মরণ কর। প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে চক্ষু বন্ধ করে ভাবতে হবে , আমি যেমন আমার অমুককে অন্ধকার কবরে একা ফেলে এসেছি, আর সে আপনজনহীন হয়ে অন্ধকার কবরে এতিমের মতো শুয়ে আছে তেমনি আমাকেও একদিন তার মতো অন্ধকার কবরে অসহায়ের মতো পড়ে থাকতে হবে। 

মৃত্যু যেমন অপরিহার্য, তেমন অনিশ্চিত তার সময়কাল। কেউ জানে কখন তার মৃত্যু হবে। তাই মুমিন সব সময়  মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন , ‘কেউ জানে না সে আগামীকাল কী উপার্জন করবে এবং কেউ জানে না তার মৃত্যু কোথায় ঘটবে। ’। সত্যিকার ইমানদার  মানুষ মৃত্যুকে নয়, ভয় পায় মৃত্যু-পরবর্তী জীবন। সে তার ইহকালে  প্রস্তুতি নিয়ে থাকে সেই পরকালের অনন্ত  জীবনের জন্য। মৃত্যুর জন্য সদা প্রস্তুত থাকে মুমিন।পবিত্র কোরআনে মৃত্যুর আগে তাওবা না করাকে ‘জুলুম’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে পবিত্র কুরআনে। আল্লাহ বলেন, ‘যারা তাওবা করে না, তারা অবিচারকারী।’  এজন্য অতীত ভুলত্রুটি ও পাপের জন্য তাওবা করার মাধ্যমে মুমিন ক্ষমা প্রার্থনা করে মরণের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। 

 মৃত্যুর প্রস্তুতি হিসেবে  নিজেকে সে সর্বদা  ভালো কাজে নিয়োজিত করে  মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা চালায়। মহানবী (সা) বলেন, ‘তোমরা নেক আমলের দিকে দ্রুত অগ্রসর হও ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতের অংশ সদৃশ ফেতনায় পতিত হওয়ার আগেই।’ 

প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সবধরনের পাপাচার থেকে নিজেকে দুরে রেখে মুমিন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ  ইরশাদ হয়েছে, ‘বলুন! আমার প্রতিপালক নিষিদ্ধ করেছেন প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা আর পাপ।’

মুমিন সুন্দর মৃত্যুর জন্য কামনা করে যেভাবে  রাসুলুল্লাহ (সা) চাপা পড়ে, গর্তে পড়ে, পানিতে ডুবে, আগুনে পুড়ে ও বিষাক্ত প্রাণীর দংশনে মারা যাওয়া থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় কামনা করতেন।

সময় বয়ে যাচ্ছে, জন্মের সাথে সাথে জীবন নামক সূর্য ক্রমে অস্তমিত হওয়ার দিক ধাবিত হচ্ছে। আর ভোগ-বিলাস, আনন্দ-আহ্লাদে সময়ক্ষেপণ নয়। এখন থেকেই আখেরাতের প্রস্তুতিতে পাথেয় সংগ্রহে নিজেকে সমর্পণ করে আল্লাহপাক ও রাসুলের (সা) সন্তুষ্টি, নৈকট্য অর্জনে সময় কাটিয়ে দিই এবং আল্লাহর নির্দেশমতে, কম হাসি এবং বেশি বেশি কাঁদি। আমাদের মন-প্রাণ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ওপর সমর্পণ করি। 

   ইহজীবনে আল্লাহপাক ও  রাসুলের (সা.) এর পবিত্র কোরআন-হাদিসের আলোকে কায়মনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ইবাদত-বন্দেগি ও আমলে সালেহ সৎকর্ম করি এবং পূর্ণাঙ্গভাবে ইসলামের আলোকে জীবন পরিচালনা করি।   এতে আমরা আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জন করে আখেরাতে নাজাত লাভে সমর্থ হব। 

আল্লাহ সবাইকে মৃত্যু তথা পরকালের জীবনের জন্য প্রস্তুত থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : আশুক আহমদ, প্রধান শিক্ষক, দক্ষিণভাগ এনসিএম উচ্চ বিদ্যালয়, বড়লেখা, মৌলভীবাজার।

সম্পাদক / দৈনিক হাকালুকি

September 2024
S S M T W T F
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930