বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যে ভরপর হাকালুকি হাওর এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হিসেবে খ্যাত। সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার ১৮১.১৫ বর্গকিলোমিটার আয়তন জুড়ে অবস্থিত। ছোট-বড় ২৩৮টি বিল নিয়েই বৃহৎ এ হাওর। হাওরটিতে ৫২৬ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। এ হাওরে শীতকালে অতিথি পাখিদের আগমণ আর বর্ষায় অথৈ নীল জলরাশি পর্যটকদের আকর্ষণীয় করে তোলে। প্রকৃতির একটু ছোঁয়া পেতে বার মাস ভ্রমণ পিপাসুরা ছুটে আসে। বিশাল সম্ভাবনাময় এ হাওরের সংরক্ষণ ও পরিকল্পনার ঘাটতি থাকায় মৎস্য অভয়াশ্রম, পাখির অভয়াশ্রম, উদ্ভিদ ও জলাভূমি দিন দিন বিলুপ্তির পথে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার ৫টি উপজেলা ও ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে এ হাওরটি বিস্তৃত রয়েছে। ছোট-বড় ২৩৮টি বিল নিয়ে দেশের সর্ববৃহৎ এ হাওর। হাওরের শতকরা ৪০ ভাগ বড়লেখা, ৩০ ভাগ কুলাউড়া, ১৫ ভাগ ফেঞ্চুগঞ্জ, ১০ ভাগ গোলাপগঞ্জ এবং ৫ ভাগ বিয়ানীবাজার উপজেলার অন্তর্গত। হাকালুকি হাওরের বিশাল জলরাশির মূল প্রবাহ হলো জুড়ী এবং পানাই নদী। এ জলরাশি হাওরের উত্তরপশ্চিমে অবস্থিত কুশিয়ারা নদী নিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বর্ষার মৌসুমে সংলগ্ন এলাকাগুলো প্লাবিত হয়ে সাগরের মতো রূপ ধারণ করে। এ সময় পানির গভীরতা হয় ২-৬ মিটার এবং আয়তন দাঁড়ায় ২৪ হাজার ৭ শ’ হেক্টরে।
মিঠা পানির অন্যতম প্রজনন কেন্দ্রও হিসেবে হাকালুকি হাওর পরিচিত রয়েছে। সরকার ১৯৯৯ সালে হাকালুকি হাওরসহ দেশের মোট ৮টি এলাকাকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া-ইসিএ) ঘোষণা করে। এরপর পরিবেশ অধিদফতর হাওরের উন্নয়নে ‘উপক‚লীয় ও জলাভ‚মি জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্প’র মাধ্যমে কাজ করে। উন্নয়ন কাজের অংশ হিসেবে ২৭টি গ্রাম সংরক্ষণ দল (ভিলেজ কনজারভেটিভ গ্রপ ভিসিজি) গঠন করে। এছাড়া জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ইসিএ কমিটি গঠন করা হয়। পরিবেশ অধিদফতরের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকালে হাওর তীরের মানুষের মধ্যে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২৩৮টি বিলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ফুটি বিল, পিংলার কোনা বিল, ঢুলা বিল, চৌকিয়া বিল, চাতলা বিল, তুরাল বিল, তেকুনি বিল, পাওল বিল, জুয়ালা বিল, কাইয়ারকোণা বিল, কাটুয়া বিল, বিরাই বিল, বালিজুরি বিল, কুকুরডুবি বিল, বারজালা বিল, মুছনা বিল, লাম্বা বিল, চিনাউড়া বিল, মায়াজুরি বিল। এ বিলগুলি বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে।
সম্প্রতি পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক এক জরীপ থেকে জানা যায়, হাকালুকি হাওরে ১৫০ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ, ৫২৬ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ২০ প্রজাতির সরীসৃপ রয়েছে। এগুলোর অধিকাংশ প্রায় বিলুপ্তির পথে। এখানে প্রতি বছর শীতকালে প্রায় ২০০ বিরল প্রজাতির অতিথি পাখির সমাগম ঘটে। হাকালুকি হাওর টেকসই উন্নয়ন, জীববৈচিত্র সংরক্ষণ, ইকোট্যুরিজম শিল্প বিকাশের এক অসাধারণ সম্ভাবনা। হাওরের তীরবর্তী প্রায় ২ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ হাওরের উপর নির্ভরশীল। ভ্রমণ পিপাসু অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী বলেন, এ হাওরে অপার সম্ভাবনা রয়েছে। মিটাপানির মাছের অভয়াশ্রমহিসেবে গড়ে তুলতে পারলে দেশের মাছের চাহিদা মেটাতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে। এছাড়া শুকনো মৌসুমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে যে অতিথি পাখি এখানে আসে এদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে হাওরে পর্যটকদের আগমণ অনেকগুন বেড়ে যাবে।
হাওরটি রামসার সাইট হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করার লক্ষ্যে গত বছর বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক নাজিয়া শিরিন । তিনি জানান, হাওরের নির্ধারিত তথ্যাদি রামসার সচিবালয়ের চাহিদানুসারে নির্ধারিত ছক পূরণ করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। পরবর্তীতে মন্ত্রণালয় থেকে এ তথ্যাদি ইরানে রামসার সাইটের সদর দপ্তরে পাঠানো হবে। এ তথ্যাদির আলোকেই হাওরটি রামসার সাইটের অন্তর্ভূক্ত হিসেবে ঘোষণা করা হবে। তিনি আরও জানান, গত বছর মৌলভীবাজার শহরের একটি অভিজাত হোটেলে এ বিষয়ের উপর কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. এ কে এম রফিক আহমদের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুল্লাহ আল মোহসীর চৌধুরী। তিনি কর্মশালায় এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন।
জানা যায়, বাংলাদেশের সুন্দরবন ১৯৯২ সালের ২১ মে রামসার স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। নীল জলের রাজ্য সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর ২০০০ সালের ২০ জানুয়ারি রামসার অঞ্চলের অন্তর্ভূক্ত করা হয়। নয়নাভিরাম এ দু’টি জায়গার পর বাংলাদেশের তৃতীয় স্থান হিসেবে রামসার অঞ্চলের অন্তর্ভূক্ত হবে হাকালুকি হাওর।
হাকালুকি/কেএ; কভার ছবি: খালেদ রহমান