• ২৪শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ১০ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ২৪শে রমজান, ১৪৪৬ হিজরি

ঘুরে আসুন বিশ্ব প্রাকৃতিক ঐতিহ্য ‘হাকালুকি হাওর’

নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত আগস্ট ২৫, ২০১৯
ঘুরে আসুন বিশ্ব প্রাকৃতিক ঐতিহ্য ‘হাকালুকি হাওর’

বাংলাদেশের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলজুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে আছে অসংখ্য নদ-নদী, হাওর-বাওর। আর এই হাওর-বাওরের একটা বিশাল অংশের অবস্থান সিলেট বিভাগে। তার মধ্যে এশিয়ার সবচেয়ে বড় হাওর  হাকালুকি। 

সিলেট ও মৌলভীবাজারের ছয়টি উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত জল সুন্দরী হাকালুকি। এই হাওরের পশ্চিমে ভাটেরা পাহাড় এবং পূর্বে পাথারিয়া পাহাড় হাকালুকির সৌন্দর্য বাড়িয়েছে দ্বিগুণ। ছোট বড় ২৩৮টি বিল, ১০টি নদী নিয়ে প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর আয়তনের এই হাওর বর্ষায় নদী খাল প্লাবিত হয়ে ২৩ হাজার হেক্টরের বিশাল জলাশয়ে পরিণত হয়। মৌলভীবাজারে ২০০ আর সিলেটে রয়েছে ৩৮টি বিল। হাওরের ৮০ ভাগ মৌলভীবাজারে আর ২০ ভাগ সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জ উপজেলায়। মৌলভীবাজারের বড়লেখা জুড়ী উপজেলা অংশে ৬০ ভাগ, কুলাউড়ায় ২০ উপজেলায় রয়েছে ভাগ।

বর্ষায় হাকালুকি সাজে অপরুপ সাজে। উত্তাল যৌবনের জয়গানে মুখরিত হয় হাওর। নীল আকাশের সাথে জলরাশির মিতালি বিমোহিত করে পর্যটকদের। বর্ষায় হাকালুকির বিস্তৃত জলরাশি দেখলে মনে হবে এ যেন মহা সাগর। যেদিকে চোখ যায় শুধু রুপোলি জলের হাতছানি। মাঝে মাঝে চোখে পড়ে জলের বুকে দণ্ডায়মান হিজল, তমালসহ নানান জলজ বৃক্ষ। গাছের ডালে অচেনা পাখিদের আনাগোনা। মৌসুমভেদে এখানে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পরিযায়ী পাখিরা এসে আশ্রয় নেয়। যে কারণে হাকালুকি শুধু হাওরই নয় পরিযায়ী পাখির বৃহৎ অভয়াশ্রমও। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় তাই হাকালুকি হাওরের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বিশাল এই হাওরে বাস করে স্থানীয় লাখো মানুষের স্বপ্ন ও জীবিকা।

তবে শুষ্ক মৌসুমে বদলে যায় হাকালুকির চিরচেনা রূপ। তখন আর পানি চোখে পড়ে না। অথৈ পানির হাওর তখন রূপ বদলে মেটে সবুজ মরুভূমির মতো দেখায়। তৈরী হয় অসীম দিগন্তের অচেনা পথ। এরূপ যেন আরো আকর্ষণীয়। শীতকালে ভোরের হাকালুকি দেখলে মনে হবে মস্তবড় দেহ নিয়ে শীতের কাছে যেন হাকালুকির আত্মসমর্পন। বিস্তৃত হাওরের বুকে তখন কোথাও ধানী জমি তো কোথাও মহিষের বাথান। বিলগুলো তখন ভেসে ওঠে হাওরের বুকে। প্রায় ১১২ প্রজাতির মাছের চারণক্ষেত্র হাকালুকির বিলে ধুম পড়ে মাছ ধরার। বিলের তীরে বসে মাছের পাইকারি হাট। দেশী ও সুস্বাদু মাছের জন্যও বিখ্যাত এই হাওরে ঠিকে আছে অনেক বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ।

হাকালুকি হাওর বাংলাদেশের সংরক্ষিত একটি জলাভূমি হাকালুকিকে দেশের অন্যতম মাদার ফিসারিজ। শীতকালে এখানে লেজা হাঁস, সরালি, পাতিসরালি, রাজ সরালি, বেলেহাঁস, ফুলুরি হাঁস, পিয়াং হাঁস, বালিহাঁস, ধলা বালিহাঁস, মরচে রঙের ভুতিহাঁস, বালিহাঁস, পাতি তিলা হাঁস, নীল মাথা হাঁস, উত্তুরে লেঞ্জা হাঁস, গিরিয়া হাঁস, উত্তুরে খুন্তি হাঁসসহ বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস এবং সারাবছর চখাচখি, জলপিপি, ময়ুরলেজা পিপি, ভুবন চিল, শঙ্খচিল, পানকৌড়ি, ধূসর বক,  পাতি পানমুরগি, নিউ পিপি, মেটেমাথা টিটি, খয়রা কাস্তে চরা, তিলা লালসা, শামুকভাঙা, সাপ পাখি, গেওয়ালা বাটান, কানা লেজ জৌরালি, বিল বাটান, পাতি সবুজলা, লালচে বক, ধূসর বক, ঢুপনি বক, পানকৌড়ি, পাতি চ্যাগা, ভুবন চিল, ফিঙে, সাদা বক, রাঙা বক, কানি বক, দেওটা, কালামাথা কাস্তেচরা, বিপন্ন জাতির কুড়াল ঈগল, পালাসি কুড়া, ঈগল, গুটি ঈগল, ফিস ঈগলসহ বিভিন্ন প্রজাতির স্থলচর জলচর ও উভচর পাখির দেখা মিলে। জলজ উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় মাকনা পুঁটি, হিঙ্গাজুর, হাওয়া। এছাড়া শাপলা শালুকতো আছেই।

পৃথিবীর বৃহৎ এই জলাধার এডভ্যাঞ্চারপ্রিয় মানুষদের ভ্রমণযাত্রার ষোলকলা পূর্ণ করতে পারে। নৌকা দিয়ে হাওরের বুকে ভেসে যেতে দেখা মিলে নৌকার উপরে মাছ শিকারীদের ভাসমান জীবন। চাইলে হাওরের মাছ কিনে খাওয়া যায় এসব নৌকাতেই। মাঝিদের বললে তারাই নৌকার পাটাতনে অস্থায়ী উনুনে গরম ভাত রেঁধে দেয়। হাওরের জলের উপর ভেসে হাওরের তাজা মাছ খাওয়ার স্বাদ পেতে অনেকেই ছুটে আসেন এখানে।  বিশেষ ছুটির দিনগুলোতে হাকালুকি হাওরে থাকে পর্যটকদের উপচে পড়া ভীড়। হাওরের জলে ক্লান্ত সূর্যের অবগাহন দেখতে অনেকে সন্ধ্যা নামার আগে ছুটে যান। বিস্তৃত হাওরের জলে গোধূলির সূর্য ডুবার অপরূপ দৃশ্য যে কাউকে নিয়ে যাবে অন্য জগতে।

হাকালুকি হাওরের নামকরণ নিয়েও রয়েছে নানা লোককথা। বলা হয়ে থাকে বহু বছর আগে ত্রিপুরার মহারাজা ওমর মানিক্যের সেনাবাহিনীর ভয়ে বড়লেখার কুকি দলপতি হাঙ্গর সিং জঙ্গলপূর্ণ ও কর্দমাক্ত এক বিস্তীর্ণ এলাকায় এমনভাবে লুকিয়ে যায় যে, কালক্রমে ঐ এলাকার নাম হয় “হাঙ্গর লুকি”, ধীরে ধীরে তা “হাকালুকি”-তে পর্যবসিত হয়। তবে আরেক জনশ্রুতি অনুযায়ী প্রায় দুই হাজার বছর আগে প্রচন্ড এক ভূমিকম্পে “আকা” নামে এক রাজা ও তাঁর রাজত্ব মাটির নিচে সম্পূর্ণ তলিয়ে যায়। কালক্রমে এই তলিয়ে যাওয়া নিম্নভূমির নাম হয় “আকালুকি” বা হাকালুকি। শুধু এটুকুই নয় প্রচলিত আছে যে, এক সময় বড়লেখা থানার পশ্চিমাংশে “হেংকেল” নামে একটি উপজাতি বাস করতো। পরবর্তিতে এই “হেংকেলুকি” নামের অপভ্রংশ হাকালুকি নাম হয়। এও প্রচলিত যে, হাকালুকি হাওরের কাছাকাছি একসময় বাস করতো কুকি, নাগা উপজাতিরা। তাঁদের নিজস্ব ভাষায় এই হাওরের নামকরণ করা হয় “হাকালুকি” যার অর্থ ‘লুকানো সম্পদ’। সত্যিকার অর্থেই হাকালুকিতে রয়েছে দীর্ঘদিনের গোপন সম্পদ। তবে সব সম্পদ লুকায়িত নয়। ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য হাকালুকির বুকে উন্মুক্ত রয়েছে প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য। যা অনায়াসেই আনন্দ দেয় পর্যটক বা ভ্রমণ পিপাসুদের। তাই অনেক পর্যটকের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু এখন জল জোছনার বিস্ময় হাওর হাকালুকি।

যেভাবে যাবেন

সায়েদাবাদ কিংবা যাত্রাবাড়ি, মহাখালি থেকে বাসে করে প্রথমে আপনাকে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, জুড়ী বা বড়লেখায় আসতে হবে। কুলাউড়া, জুড়ি অথবা বড়লেখা থেকে অটোতে করে চলে যেতে পারেন হাকালুকিতে। এক্ষেত্রে ভাড়া গোনতে হবে ১৫০-২০০ টাকা। কয়েক ঘন্টার জন্য নৌকা ভাড়া ছোট ৮০০ টাকা এবং বড় নৌকা ১২০০ টাকায় মিলবে। এক্ষেত্রে দরদাম করে নিয়ে যাওয়া ভালো।

ট্রেনে করে আসতে চাইলে কমলাপুর কিংবা বিমানবন্দর স্টেশন থেকে সিলেটগামী ট্রেনে চড়ে চলে আসতে হবে কুলাউড়া রেল স্টেশনে। এখানে এসে অবশ্য বাড়তি ভালো লাগা কাজ করবে। যদি জানেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন সিলেট এসেছিলেন তখন এই কুলাউরা স্টেশনেও এক রাত কাটিয়েছিলেন। কুলাউড়া রেল স্টেশন  থেকে অটোতে করে চলে যেতে পারেন হাওরে।

March 2025
S S M T W T F
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031