উনিশ শতকের শেষের দিকে ইউরোপ জুড়ে ইহুদিদের প্রতি বিদ্বেষ বাড়তে থাকায় তারা নিজেদের জন্য একটি স্বাধীন দেশের আশা করতে থাকে। সে সময় ব্রিটিশরা ইউরোপীয় ইহুদিদেরকে ফিলিস্তিনে উপনিবেশ গড়ে তুলতে সাহায্য করে। ইসরায়েল ফিলিস্তিন দ্বন্দের শুরুটাও হয় তখন থেকেই।
আদিঃ উনিশ শতকের শেষের দিকে ফিলিস্তিন ছিল তুরস্কের বিখ্যাত অটোমান বা উসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। তখন ফিলিস্তিনের মোট জনসংখ্যার ৯৭ শতাংশ ছিল মুসলিম। আর বাকী ৩ শতাংশ ছিল ইহুদি। তারপর ১৯০৫ থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় কয়েক গুণ। এর কারণ ছিল পশ্চিমা বিশ্বের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। সাধারণ ইউরোপিয় খ্রিস্টানদের মনে প্রবল ইহুদি বিদ্বেষ তৈরি ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এর পরবর্তী ত্রিশ বছরে ব্রিটিশদের সরাসরি সহযোগিতায় ছয় লক্ষাধিক ইউরোপীয় ইহুদি ফিলিস্তিনে প্রবেশ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর ফিলিস্তিনসহ বেশীরভাগ আরব এলাকা চলে যায় ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের দখলে। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জেমস বেলফোর ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে একটি সার্বভৌম ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। ইতিহাসে এটি বিখ্যাত ‘বেলফোর ঘোষণা’ নামে পরিচিত। ১৯১৮ সালে ব্রিটিশদের সহযোগিতায় ‘হাগানাহ’ নামে ফিলিস্তিনে একটি গোপন সসস্ত্র ইহুদি বাহিনী গঠিত হয়। প্রথম দিকে এর কাজ সাধারণ ইহুদিদের সাহায্য করা হলেও পরবর্তীকালে তারা সন্ত্রাসী বাহিনীতে রুপান্তরিত হয়। ফিলিস্তিনিদের হত্যা, নির্যাতন, লুণ্ঠন ও তাদের বাড়ি-ঘর খেত-খামার জবরদখল করাই হয় ‘হাগানাহ’র কাজ। বর্তমান ইসরায়েলি সেনাবাহিনি এই ‘হাগানাহ’র পরিবর্তিত রূপ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সর্বপ্রথম স্বাধীন ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাব অনুযায়ী ইহুদিরা ফিলিস্তিনের মোট জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগ হয়েও তারা পায় মোট ভূমির ৫৭ শতাংশ। আর ফিলিস্তিনিরা পায় নিজেদের মাতৃভূমির মাত্র ৪৩ শতাংশ। এই প্রস্তাব গ্রহণের মাসের মাথায় ইসরায়েলি সন্ত্রাসীদের হাতে সতের হাজারের অধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়। ১৯৪৮ সালের ১২ই ইহুদি নেতা ডেভিড বেনগুরিওর ইসরায়েলের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এ ঘোষণার মাত্র দশ মিনিট পর আমেরিকা সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দেয়। তার পরপরই সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ব্রিটেন স্বীকৃতি দেয়। জাতিসংঘ ও পশ্চিমা শক্তির সহায়তায় ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলেও গঠিত হয়নি ফিলিস্তিন নামের স্বাধীন রাষ্ট্র। তারপরেই শুরু হয় আরব ইসরায়েল যুদ্ধ্ব। যুদ্ধে ফিলিস্তিনের ৫০০ টি গ্রামের মধ্যে ৪০০ টিকেই জনশূন্য করে ফেলে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। ফিলিস্তিনের যে অংশটুকু ইসরায়েল দখল করতে পারেনি সে অংশটুকু মিশর ও জর্ডানের মধ্যে ভাগাভাগি করে দেয়।
মানচিত্রে দেখুন কিভাবে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের ভুমি দখল করেছে
সেই থেকেই পশ্চিমা বিশ্বের মদদপুষ্ট ভুঁইফোড় রাষ্ট্র ইসরায়েল ও তার সামরিক বাহিনীর হাতে বিশ্ব মানচিত্রের বুকে প্রকাশ্য লাঞ্ছনা ও নিপীড়নের স্বীকার হচ্ছে ফিলিস্তিনের মুসলিম জনগন। যা এখনও চলছে। এর শেষ কোথায় আমরা কেউ জানিনা।
ইসরায়েল নিয়ে একটি ভ্রান্ত ধারণাঃ আমরা অনেকেই জানি মুসলিম খ্রিস্টান ও ইহুদি জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম আঃ এর পুত্র ইসহাক আঃ এর পুত্র ইয়াকুব আঃ এর আরেক নাম ছিল ইসরায়েল। হিব্রু ভাষায় ইসরায়েল অর্থ স্রষ্টার গোলাম। ইব্রাহিম, ইসহাক ও ইয়াকুব আঃ এর বংশের এই ধারাটিতে আল্লাহ তায়ালা হাজার হাজার নবীগণকে পাঠিয়েছেন। অনেকের ধারণা ইয়াকুব নবীর নামানুসারে আধুনিক রাষ্ট্র ইসরায়েল ও এর বর্তমান ইহুদি অধিবাসীরা সবাই মনে হয় হযরত ইব্রাহিম, ইসহাক, ইয়াকুব, মুসা আঃ এদেরই কিন্তু না, সত্য কথা হচ্ছে বর্তমান ইসরায়েল রাষ্ট্রের অধিবাসি ইহুদিরা মোটেও তা নয়। বরং তারা ইউরোপীয়, এবং ধর্মান্তরিত ইহুদি। তারা সাদা চামড়ার ককেশীয় যারা বিভিন্ন সময় ইউরোপের বিচ্ছিন্ন গোত্রের, প্যাগান, কৃষিজীবী সম্প্রদায় ভুক্ত লোক যারা বিভিন্ন সময় সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে জুদাইজম বা ইহুদিবাদ কে ধর্ম হিসেবে বেছে নিয়েছিল। আধ্যাত্মিক ভাবনার চেয়ে নিজেদের টিকিয়ে রাখার সামাজিক কৌশল হিসেবে যারা ধর্মান্তরিত হয়েছিল। পরে উনিশ শতকে ইউরোপের দেশে দেশে প্রবল জাতীয়তাবাদ, খ্রিস্টানদের মধ্যে থেকে বিভিন্ন শ্রেণীর উগ্র মতাদর্শের দল তৈরি হওয়ায় ইউরোপে প্রবল ইহুদি বিদ্বেষ শুরু হয়। অথবা বলা যেতে পারে এ সবই ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। যাই হোক জেরুজালেম বাসী অথবা আরব খ্রিস্টান ও ইহুদি সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ আমাদের রাসুল মুহাম্মাদ সাঃ এর পর খিলাফায়ে রাশেদিনের আমলে মুসলমান হয়ে গিয়েছিল। অতএব বর্তমান ইহুদি বা খ্রিস্টানরা না আরব না বনী ইসরায়েল।
অন্তঃ অবশেষে নিজ ভূখণ্ডে ইসরায়েলি আগ্রাসন সহ্য করতে করতে ১৯৮৭ সালে এসে ফিলিস্তিনিরা শুরু করে প্রথম ‘ইন্তিফাদা’। অর্থাৎ নবজাগরণ। ১৯৮৮ সালের ১৫ই নভেম্বর প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগ্যানাইজেশন ‘পিএলও’ এর নেতা ইয়াসির আরাফাত ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। কিন্তু তখনও পর্যন্ত কোনো ভূখণ্ড তাদের দখলে ছিল না। ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনের প্রথম ইন্তিফাদা কার্যকর ছিল। এরপর ২০০০ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত চলে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা। ২০০৬ সাল থেকে ফিলিস্তিনিরা প্রধান দুটি দলে বিভক্ত হয়ে পরে। এদের একটি হলো ‘ফাতাহ’ এবং অপরটি ‘হামাস’। এরমধ্যে ‘ফাতাহ’কে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন স্বীকৃতি দিলেও ‘হামাস’কে অনেকেই একটি সন্ত্রাসী সংগঠন বলে আখ্যা দিয়ে থাকেন। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই স্বাধীনতার জন্যে ইহুদিদের সাথে মুসলমানদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলছেই। যেখানে আক্রান্ত, নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত ফিলিস্তিনি মুসলমানরাই বেশী। অন্যদিকে পশ্চিমা মিত্রদের সহযোগিতায় দিনদিন আরও অপ্রতিরোদ্ধ হয়ে উঠছে ইসরায়েল। ফিলিস্তিনিদের লাশের মিছিল আরও কতটা দীর্ঘ হলে তারা পাবে তাদের সপ্নের স্বাধীনতা তা এখনও অজানা। মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রক সৌদি আরব সহ ক্ষমতাধর সকল দেশই প্রতিষ্ঠিত হওয়া থেকে এখনও চলছে পশ্চিমা মিত্রদের ইশারায় সেখানে কোন রকম আন্তর্জাতিক সহায়তা ছাড়া ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যে দুর্ভোগ ছাড়া কি ঘটতে চলেছে আমরা জানিনা।