• ৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ৫ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

যৌতুক প্রথা সামাজিক ব্যাধি : আফিয়া বেগম শিরি

নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত অক্টোবর ৩১, ২০২০
যৌতুক প্রথা সামাজিক ব্যাধি : আফিয়া বেগম শিরি

যৌতুক নিয়ে লেখার জন্য অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী অনুরোধ করে যাচ্ছেন। যৌতুক আমাদের সমাজে মহামারী হয়ে দাঁড়িয়েছে। যৌতুক নেয়া দেয়ার ব্যাপারে দাম্পত্য জীবনে কতটুকু প্রভাব পড়তে পারে বা পড়ছে তা জেনেও আমরা বিরত থাকছি না। আপনার হয়তো অগাধ টাকা পয়সা সামর্থ্য আছে মেয়েকে আধুনিক ফার্নিচার যাবতীয় সরঞ্জামাদী শশুড় পক্ষের চাহিদা অনুযায়ী কিংবা তার চেয়ে বেশী দিতে পারবেন কিন্তু যাদের ঘরে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, অভাবগ্রস্হ পিতার মাথার উপরে তা কতটুকু ভারী বোঝা শুধু তারা অনুভব করতে পারবেন।

বর্তমান যুগে বিয়ের কথাবার্তা শুরু থেকে পাত্র-পাত্রী পক্ষ সোনা গহনা, মোহরানা, নগদ কাবিন, কনের লেহেঙ্গা, পাত্রের দামী খাট, পালঙ্ক, ফ্রিজ, টিভি, মোটর সাইকেল এই সব নিয়ে চুড়ান্ত আলোচনায় মেতে ওঠেন। সামর্থবানরা হয়তো এ ধাক্কা কুলিয়ে উঠার মত পর্যাপ্ত টাকা পয়সা আছে। না হয় পাত্রকে দেনার বোঝা মাথায় চাপিয়ে কাজ সমাধা করতে বাধ্য করা হয়। শেষ পর্যন্ত সেই দেনার দায়ে দাম্পত্য কলহ সৃষ্টি হয়ে বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম অথবা ভেঙ্গে যায়। এদিকে যাদের অভাবী সংসার তারা যুগের (ধনবানদের) সাথে তাল মিলিয়ে বিয়ের কাজ সমাধা করতে গিয়ে নি:স্ব হন। কন্যাদায়গ্রস্থ বাবা মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে জমি বন্দক দিয়ে পাত্রপক্ষের সব দাবী দাওয়া পূরন করেন। আত্নীয় স্বজনদের কাছে সাহায্যর হাত বাড়ান।

একটি পরিবারের সাথে বৈবাহিক সমন্ধ করতে গিয়ে সর্বপ্রথম ছেলে/ মেয়ের যোগ্যতা, ব্যবহার, একে অন্যের সাথে যায় কী না তা যাচাই করা অত্যাবশক। মেয়ে কিংবা ছেলের পরিবারের সামর্থ কতটুকু সে দিক বিবেচনা না করে চাপ সৃষ্টি করা হয়। হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। উভয় পক্ষের মধ্যে মনোমালিন্য দেখা দেয়। ছেলে মেয়ের সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে। তার খেসারত দিতে হয় মেয়েটিকে। আমার জানামতে যে পরিবারে একজন মাত্র উপার্জনকারী বাবা কিংবা ভাই থাকে সেই পরিবারের মেয়ের বিয়ের সময় পাত্র পক্ষ মোটা অংকের যৌতুক দাবী করেন, পাত্র পক্ষ কিছু দিক আর না দিক মেয়ের বাবাকে সম্পূর্ন ফার্নিচার দিয়ে পাত্রস্হ করতে হয়। এই বৈষম্যতা বিশেষ করে শুধু মেয়েদের বেলায় ঘটে। পাত্রের যদি বসত ভিটা না-ও থাকে তবুও সে পুরুষ, এমন মনোভাব থাকে। তার সব কিছু পাওয়ার অধিকার ষোল আনা থাকতে হবে। খাট থেকে শুরু করে রেডিও, টিভি, ফ্রিজ কোনটাই বাদ যায় না। মোটর সাইকেলের ডিমান্ডও কম যায় না।
এমন ঘটনাও শুনেছি পাত্র অন্যের বাড়িতে ছুপড়ি ঘর বানিয়ে কোনো রকমে দিনাপাত করে, তারপরও সে চায় বেশী না হলেও তার একটি টিভি চাই, যদিও সে জানে তা রাখার মতো জায়গার সংকুলান করা তার জন্য কঠিন। মেয়ের পরিবারটি বেশ কঠিন পরিস্হিতির মুখে পড়তে হয়।
আমাদের সমাজে যৌতুক শব্দটি খুব ভয়াবহ আকার ধারন করে আছে। এই যৌতুকের কারনে কতো মেয়ের প্রান বলি দিতে হয়েছে ,কতো বাবারা লজ্জায় জীবন দিতে হয়েছে। মেয়ের উপর চাপ সৃষ্টি করে শশুড় বাড়ি থেকে টাকা আনিয়ে জামাই বিদেশ যেতে চাচ্ছে। আশানুরূপ টাকা না পেলে মেয়ের উপর অত্যাচার নির্যাতন শেষ পর্যন্ত বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটছে। অসহায় মেয়ের পরিবার দেনার পাহাড় জমিয়ে মেয়ের শশুড় বাড়ির লোকজনকে সন্তুষ্ট রাখতে হচ্ছে। তারপরও চাহিদার শেষ নেই।

আমরা কি পারি না এ থেকে বেরিয়ে আসতে? সচেতন মহল যদি প্রথমে এর অপকারিতার দিক বিবেচনা করে প্রতিকারের ব্যবস্হা করেন তবে সমাজ পরিবর্তন হবে। সাথে সাথে কন্যাদায়গ্রস্থ বাবা দেনার পাহাড় থেকে পরিত্রান পাবে। পাত্রকে রিনের বোঝা মাথায় নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়তে হবে না।
একটি দাম্পত্য জীবন সুখের দেখতে চাইলে উভয় পক্ষের গার্ডিয়ানদের মানসিকতার পরিবর্তন আনা জরুরী। ছেলে মেয়ের বিবাহের সুত্রে সুন্দর একটি আত্নীয়তার বন্ধন গড়ে ওঠে। সেখানে সমবোঝতার ক্ষেত্রে গড়মিল হলে সে সংসার ভাঙ্গন ধরবেই। তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপে সুন্দর সংসারটি শেষ পর্যন্ত আর ঠিকে থাকে না।

বিলেতে বড় হওয়া সন্তানরা যৌতুক দেয়া নেয়া পছন্দ করে না। শশুড় বাড়ি থেকে ফার্নিচার দিতে চাইলেও নিষেধ করে। কারন ঘর বাড়ি নিয়ে থাকলে সবার সংসারেই চলনসই ফার্নিচার থাকে, বাড়তি খাট পালং অহেতুক টাকা পয়সা অপচয় ছাড়া আর কিছুই না। সমস্যা শুধু আমাদের মাঝে। আমরা মনে করি যা পাই তা নিতে অসুবিধা কি। জায়গার সংকুলান হোক বা না হোক এটা আমার প্রাপ্য। মেয়েরা স্বর্ণ গহনা তেমন একটা পরতে চায় না, তারপরও আমরা স্বর্ণের দিকে ঝুকে পড়ি। দর কষাকষি চলে। প্রতিযোগিতায় মেতে উঠি। স্বর্ন দিয়ে ভবিষ্যত মাপি। আরেকটি জিনিস আমরা গার্ডিয়ানরা দেন মোহর পরিশোধের ব্যাপারে কৃপনতা দেখাই। ছেলের আর্থিক সামর্থ অনুযায়ী দেন মোহর ধার্য্য করা উচিত এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে নগদ পরিশোধ করার ব্যবস্হা হলো উত্তম পন্থা।

দেশে হোক আর বিদেশে হোক পারিবারিক মুল্যবোধে সৌজন্যতার খাতিরে একান্ত যদি মেয়ের জামাইকে উপহার সামগ্রী দিতে হয় কিংবা দেয়ার মতো সামর্থ থাকে তবে ছেলে মেয়ের একাউন্টে কিছু টাকা দিন। ওরা ওদের মতো করে সেটা কাজে লাগাতে পারবে। ফার্নিচার কিনতে হলে কিনুক কিংবা বাড়ি কেনার ডিপোজিট দিক, নতুন গাড়ি কিনুক। কিংবা বিবাহ পরবর্তী কোথাও বেড়িয়ে আসুক। তাদের একটা সুন্দর ভবিষ্যত পরিকল্পনা থাকতে পারে। আপনি একদিকে তাদের মাথার বোঝা হালকা করলেন অপরদিকে সুন্দর একটি ভবিষ্যত গড়ে দেয়াতে সামিল হলেন।

লেখক: আফিয়া বেগম শিরি, সমাজকর্মী

September 2024
S S M T W T F
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930