২০০৪ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী, মৌলভীবাজারের কৃতি সন্তান মরহুম এম সাইফুর রহমানের উদ্যোগে জুড়ী একটি উপজেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এই উদার মনের জনন্দিত ব্যক্তিত্বের প্রতি জুড়ীবাসী কৃতজ্ঞতা শেষ হবার নয়। উপজেলা ঘোষণার পর থেকেই জুড়ীর রাজনীতি নতুন মোড় নেয়। জুড়ীর বিভক্ত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ একই প্লাটফর্মে রাজনীতি করার সুযোগ পান। আওয়ামীলীগ নেতা মরহুম আব্দুল খালিক চৌধুরী, মরহুম আজির উদ্দীন, বীর মুক্তিযোদ্ধা বদরুল হোসেন, মরহুম এম এ মুমিত আসুকসহ সকল আওয়ামী নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে আওয়ামিলীগ নেতাকর্মীরা এবং বিএনপি নেতা আসাদ উদ্দীন বটল, গিয়াস উদ্দীন, মুজিবুর রহমান, মরহুম নুরুল ইসলামসহ সকল বিএনপি নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে বিএনপি নেতাকর্মীরা জুড়ী কেন্দ্রিক রাজনৈতিক চর্চা শুরু করেন। অন্যান্য রাজনৈতিক দলও জুড়ীতে তাদের নেতৃত্বের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্মের সুযোগ পায়। উপজেলা হওয়ার আগে জুড়ীর জনগণ দুইজন জনপ্রতিনিধির দিকে চেয়ে থাকতে হতো। কিন্তু এখন অন্তত জুড়ীবাসী এটা বলতে পারে যে তাঁদের জনপ্রতিনিধি আলহাজ্ব শাহাব উদ্দীন আহমেদ।
২০১৫ সালে জুড়ীর রাজনীতিতে নতুন এক প্রাপ্তি যোগ হয়। জুড়ীর কৃতি সন্তান এস এম জাকির হোসাইন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে জুড়ীর পরিচিতি উল্লেখযোগ্য হয়ে যায়। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে জাকির হোসাইন ইতিমধ্যেই জাতীয় রাজনীতিতে সিলেটের প্রতিনিধিত্ব করার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছেন। মেধা ও যোগ্যতায় নেতৃত্বের শিখরে পৌঁছা এই ছাত্রনেতার রাজনৈতিক শিষ্টাচার তাঁকে অন্যদের থেকে ব্যতিক্রম করে রেখেছে। নিঃসন্দেহে তাঁর এই অর্জন জুড়ী তো বটেই, সিলেটবাসীর জন্য গৌরবের। ছাত্রনেতা হিসেবে সাফল্য অর্জন করা এস এম জাকির হোসাইন জননেতা হিসেবে কতটুকু সফল হতে পারবেন? তাঁর এলাকার জনগণের কাছে নিজেকে কতটুকু গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারবেন? সেটা বলা সময় সাপেক্ষ। তবে তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যতের সাথে মৌলভীবাজার তথা সিলেটের ভবিষ্যতের সমীকরণ এক ও অভিন্ন, সেটা সহজেই অনুমেয় । আর জুড়ীর সন্তান হিসেবে জুড়ীর কথা তো বলার অপেক্ষা রাখেনা।
প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীববৈচিত্র্যে ভরপুর জুড়ী একটি সম্ভাবনাময় উপজেলা। হাকালুকি হাওড়ে উৎপাদিত ফসলাদি এবং মৎস সম্পদ, পাহাড়ে উৎপাদিত বনজ সম্পদ, কমলালেবু, আগর আতর ইত্যাদি এই অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম একটি উপাদান। তাছাড়া ভারতের আসাম এবং ত্রিপুরা দুটি রাজ্যের সাথেই সীমান্ত থাকায় আন্তঃবাণিজ্যের ক্ষেত্রে জুড়ী উপজেলা একটি সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। ইতিমধ্যেই জুড়ী শহর থেকে আসাম সীমান্তবর্তী লাঠিটিলা সড়ক নির্মিত হয়ে গেছে এবং ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী বটুলী সড়কও নির্মানাধীন। কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ পুননির্মাণের কাজও চলছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের মাধ্যমে ভারতের দুই রাজ্যের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালু হলে জুড়ী হবে একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। উন্মোচিত হবে জুড়ীর বাণিজ্যিক অপার সম্ভাবনার দ্বার।
প্রাকৃতিক সম্পদের পাশাপাশি খনিজ সম্পদের অপার সম্ভাবনা রয়েছে জুড়ীতে। জুড়ীর হারারগজ পাহাড় এলাকায় “তরল সোনা” খ্যাত পারমাণবিক জ্বালানি ইউরেনিয়াম আকরিকের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই খনিজ পদার্থ উত্তোলনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বদলে যাবে। ১৯৮১ সালের মার্চ মাসে ঐ এলাকা পরিদর্শনে আসেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মরহুম জিয়াউর রহমান। তিনি এই খনিজ পদার্থ উত্তোলনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আশাবাদ ব্যক্ত করলেও এর কিছুদিন পর তিনি মর্মান্তিকভাবে নিহত হন।এরপর বারবার এই ইউরেনিয়াম উত্তোলনের আলোচনা উঠলেও অজানা জটিলতায় সেটা বাস্তবায়ন হচ্ছেনা।
পর্যটন এলাকা হিসেবেও জুড়ীতে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। হাকালুকি হাওর, পাথারিয়া পাহাড় ও কালাপাহাড়পুঞ্জের বর্ধিত অংশের উঁচু নিচু টিলা, চা-বাগান, কমলালেবু এবং আগর বাগান ইত্যাদির জন্য এই এলাকা পর্যটনপ্রেমীদের আগ্রহের কারণ হতে পারে। ২০১৯ সালে জুড়ী-বড়লেখা আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব শাহাব উদ্দীন আহমেদ বন,পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ার পর এই অঞ্চলের পর্যটন সম্ভাবনা একটি প্রত্যাশায় পরিণত হয়েছে। ইতিমধ্যেই তিনি যোগাযোগ অবকাঠামোর অনেক উন্নয়ন করেছেন। সম্প্রতি কচুরগুল-লাঠিটিলা এলাকায় একটি ইকোপার্ক করার জন্য ইতিমধ্যে বাজেটও পাশ হয়েছে। তবে এধরণের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কুলাউড়া -জুড়ী-বড়লেখাকে নিয়ে একটি মেগা প্রকল্প হাতে নেয়া প্রয়োজন। মাননীয় মন্ত্রী ইচ্ছা করলে তাঁর ক্ষমতা ও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে এই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মান বদলে দিতে পারেন। জুড়ী একটি শান্তিপূর্ণ এলাকা। সৌহার্দ্য সম্প্রীতি বজায় রেখে ধর্ম বর্ন জাতপাত নির্বিশেষে দীর্ঘদিন থেকে সবাই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করছে। রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেও সেটা জুড়ীর সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়না। রাজনৈতিক সহিংসতাও এখানে খুব একটা চোখে পড়ার মত নয়। একটি সীমান্তবর্তী এলাকা হিসেবে শিক্ষা, সংস্কৃতি জীবনযাত্রার দিক দিয়ে জুড়ী অনেক অগ্রসর। জুড়ীর অনেক মেধাবী ও গুণী মানুষ প্রশাসনসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশায় ভালো অবস্থানে থেকে সুনাম অর্জন করে যাচ্ছেন। জুড়ীবাসী ঐক্যবদ্ধভাবে তাঁদের এলাকা ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন কাজ করলে একদিন জুড়ী একটি আদর্শ উপজেলা হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে।
হাকালুকি/জুড়ী/শামসুল