• ৩০শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ১৭ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ২রা জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি

সুন্দরী কমলা নাচে : মঞ্জুরে আলম লাল

নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত নভেম্বর ১৪, ২০২০
সুন্দরী কমলা নাচে : মঞ্জুরে আলম লাল

দেশে যত রকম ফল আছে, তার মধ্যে অন্যতম সুস্বাদু ফল হচ্ছে কমলা। লেবুু প্রজাতির এ ফলটির নাম শুনলেই যে কারো জীবে জল আসবে। কমলা খেতে ইচ্ছে করেনা, এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। এই কমলা নিয়ে অনেক সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি হয়েছে। সেই প্রাচীণ কাল থেকে কমলার বনবাস, কমলা রানীর দীঘি’র রোমাঞ্চকর ঘটনাবলি এখনো মানুষের মুখে মুখে ফিরে। বিশ্বকাপ ফুটবলে কমলা ঝড় দেখে উৎসুক দর্শক। ‘সুন্দরী কমলা নাচে……’ গানটি বহমান থাকবে অনন্ত কাল। অনেক শিশুর নামও এ ফলের নামে রাখা হয়। সর্র্বশেষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার কল্যাণে কমলা নামটি বিশ্বে আলোচিত হচ্ছে। স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যেতে সাথে করে কমলা নিয়ে গেলে সবাই খুশী হন। বিশেষ করে রোগীর জন্য কমলা অন্যতম একটি পথ্য হিসেবে ব্যবহার্য।
বৃহত্তর সিলেট এক সময় কমলার জন্য বিখ্যাত ছিল। সাবেক সিলেট জেলার প্রত্যন্ত পাহাড়ী অঞ্চলে প্রতিটি বাড়িতেই শখের বসে কমলা চাষ করা হতো। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোগ-বালাই, বিভিন্ন পোকার আক্রমন, বন্য প্রাণির উপদ্রব, চোরের উৎপাত, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও আধুনিক প্রযুক্তির অভাব, বাণিজ্যিক চিন্তার কমতি, ভালো-উন্নত জাতের চারা ও কীটনাশকের অপ্রতুলতা, বাজারজাতকরণে প্রশাসনিক হয়রানি এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে বসত ঘর নির্মাণ ইত্যাদি কারনে পর্যায়ক্রমে কমলার উৎপাদন কমে যায়।
তবে সেই অবস্থা এখন আর নেই। চাষিদের উৎসাহ ও উদ্যোগ, সরকারি সহযোগিতা, প্রশিক্ষণ, ঋণ ও প্রয়োজনীয় সবকিছুর সহজলভ্যতার ফলে বৃহত্তর সিলেটে আবারও শুরু হয় কমলা চাষ। বিশেষ করে মৌলভীবাজার জেলায় কমলা চাষের উৎসব শুরু হয়। কমলা চাষের মধ্য দিয়ে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য দুরীকরণ হয়। অনেক পরিবার হচ্ছে স্বাবলম্বী। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় দিনের পর দিন কমলা চাষের পরিধি বৃদ্ধি পায়। বিদেশে যাবার প্রবণতা বাদ দিয়ে অনেকেই কমলা চাষে মনোযোগী হন। পাহাড়ী অঞ্চলের পাশাপাশি বস্তি এলাকায় অনেকে বাড়ির আঙ্গিনায় সুযোগমত কমলা গাছ লাগাচ্ছেন।
মৌলভীবাজার জেলায় সবচেয়ে বেশি কমলা চাষ হয় জুড়ী উপজেলায়। উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখন কমলা চাষ হচ্ছে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী গোয়ালবাড়ি ইউনিয়নের হায়াছড়া, লালছড়া, শুকনাছড়া, কচুরগুল, লাঠিটিলা গ্রাম গুলোতে ব্যাপক আকারে বাণিজ্যিক ভাবে কমলা উৎপাদন হচ্ছে। এছাড়াও উপজেলার জামকান্দি, গোবিন্দপুর, দুর্গাপুর, বড়ধামাই, আমতৈল, হামিদপুর, বাহাদুরপুর, হাসনাবাদ, চম্পকলতাসহ বিভিন্ন গ্রামে কমলা চাষ হয়।
স্থানীয় কমলা চাষিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ১৯৬২-৬৩ সালে তৎকালীন ত্রিপুুরা জেলার (বর্তমান কুমিল্লা) বাসিন্দা জমির হোসেন হায়াছড়া এলাকার জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে এসে বসতি গড়েন। সে সময় তিনি সেখানে কমলা, জাম্বুরা ও লেবু চাষ শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে হায়াছড়ায় বসতি বাড়ার পাশাপাশি কমলার চাষও বাড়তে থাকে। তখন অবহেলায় ও সনাতন পদ্ধতিতে কমলা চাষ হতো। বাণিজ্যিক চিন্তা ভাবনা যেমন ছিল না, তেমনি আধুনিক প্রযুক্তি থাকা দুরের কথা কল্পনাও ছিল না। পুরো এলাকা জঙ্গলে পরিপূূর্ণ ছিল। জংলি হাতীর আক্রমনে তটস্থ থাকতো লোকজন। লংগাই পাহাড় থেকে নেমে আসত জংলি হাতীর দল। দু’গাঙ্গাতি গাঙ্গা ও চৌগাঙ্গা এলাকায় ৮/১০টি করে জংলি হাতী এসে কমলা গাছ ভেঙ্গে ফেলত। সেই সাথে বানর, কাঁঠবিড়ালী ও বন্য শুকুর কমলার ক্ষতি করতো। তারপরও কমলা চাষ পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকে। শুরু হয় বাজারজাতকরণ। কালের আবর্তনে জংলি হাতীসহ বন্যপ্রাণীর আক্রমন অনেকটা কমলেও প্রশাসন নামক নতুন এক দানবের আক্রমন শুরু হয় কমলাচাষিদের উপর। বহু শ্রমের বিনিময়ে উৎপাদিত কমলা বিক্রি করতে প্রশাসনের অনুমতি নিতে হত। বাজারে কমলা নিয়ে গেলে উহা হয়ে যেত নিজ দেশে পরবাসী। নব্বই দশকের শুরুর দিকে এরকম নানা যন্ত্রণা নেমে আসে কমলাচাষিদের উপর। দেশীয় কমলাকে ভারতীয় আখ্যা দিয়ে ভাগ বসাত পুলিশ-বিডিআর। তাদের খুশী করতে না পারলে শারীরিক অত্যাচারের পাশাপাশি জেল-জরিমানা বহন করতে হত। ১৯৯৬ সালে ৪০ হাজার কমলাসহ হায়াছড়া গ্রামের ইব্রাহিম আলীকে আটক করে বিডিআর। এক সপ্তাহ জেল খাটেন তিনি। প্রশাসনের এ হয়রানি মূূলক জটিলতায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন কমলাচাষিরা। আগ্রহে ভাটা নামে কমলা চাষে। চাষিদের জীবনে নেমে আসে দৈন্য-দশা। পর্যায়ক্রমে কমলা বাগান গুলোতে ধস নামে।
এমনি এক বিপর্যয়কর অবস্থায় এগিয়ে আসে সরকার। গ্রহণ করা হয় বিভিন্ন প্রকল্প। কমলার অতীত ঐতিহ্য রক্ষা ও দেশের চাহিদা পুরনে ২০০১ সালে বৃহত্তর সিলেট জেলায় কমলা ও আনারস উন্নয়নসহ সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প চালু করা হয়। মৌলভীবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে জুুড়ী উপজেলার হায়াছড়া ও কচুরগুল এলাকায় ৬৯ হেক্টর জমি নিয়ে এ প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তিতে এর মাত্রা প্রবল আকারে বৃদ্ধি পায়। তখন থেকে বদলে যেতে থাকে দৃশ্যপট। প্রকল্পের উদ্যান উন্নয়ন কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন কৃষকদের পাশে দাঁড়ান। কৃষকরা নতুন করে আশায় বুক বাঁধে। কৃষি অধিদপ্তরের কমলা প্রকল্প থেকে চাষিদের প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু হয়। প্রশিক্ষণ নিয়েই চাষিরা কমলা চাষে মনোযোগী হন। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি চাষিদের বিনামূল্যে চারা ও সার দেয়া হলে তাদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়। বিস্তৃত হতে থাকে বাগানের পরিধি। প্রশিক্ষণ নিয়ে পুরণো গাছের পরিচর্যায় ফলন ৪/৫ গুণ বেশি, ফল বড় ও মিষ্টি হয়। প্রকল্প চলাকালে কৃষি বিভাগ থেকে চাষিদের বিভিন্ন রকম পরামর্শ ও কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে ওষুধ দেয়া হত। ২০০৫ সালে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে চাষিদের চাহিদা ও দাবিতে প্রকল্পের মেয়াদ ২০০৮ সালের জুুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু সৃজিত বাগানে ফল আসার আগেই প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাষিরা বিপাকে পড়েন।
কমলার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বৃষ্টি। গাছে ফল আসা, বড় হওয়া, রং ধরা ও মিষ্টি হওয়ার জন্য বৃষ্টি অন্যতম একটি উপাদান। বৃষ্টি না হলে সেচের বিকল্প নেই। কিন্তু দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় সেচের কোন ব্যবস্থা নেই। ঠান্ডার ছোঁয়া না পেলে কমলার আকার বৃদ্ধি পায়না, রং ধরেনা ও মিষ্টি হয়না। পানির অভাবে ফল ঝরে পড়ে। বানরের উৎপাত, বিভিন্ন রকমের পোকা, কীটপতঙ্গ গাছ ও ফলের মারাত্বক ক্ষতিসাধন করে। ২/৩ রকেেমর গান্ধী পোকা আছে, যা গাছের যেখানে বসে সেখানেই পচন ধরে। অন্যান্য পোকা ছাল খেয়ে গাছ ছিদ্র করে ফেলে। এতে গাছ দুর্বল হয়ে যায়।
কমলা চাষিরা বলেন- বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কমলা চাষে কৃষকরা উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু সেচ সুবিধা না থাকা, কার্যকর কীটনাশকের অভাব ইত্যাদি কারনে কৃষকরা এগুতে পারছেন না। গভীর নলকুপ স্থাপনের মাধ্যমে পানি সেচের ব্যবস্থা করা গেলে কৃষকরা অনেকটা লাভবান হতেন।
জুড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন বলেন, চলতি বছর জুড়ীতে ৯১ হেক্টর জমিতে কমলা চাষ হয়েছে। বৃষ্টি হতে দেরী হওয়া এবং সেচ সুবিধা না থাকায় এবার ফল কিছু কম হয়েছে। নিয়মিত সহযোগিতা ছাড়াও ২০১৯-২০ অর্থ বছরে শুরু হওয়া লেবু জাতীয় ফসলের সম্প্রসারণ ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের আওতায় কমলা চাষিরা উপকৃত হচ্ছেন।
জানতে চাইলে জুড়ী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বীরমুক্তিযোদ্ধা এম এ মোঈদ ফারুক বলেন, জুড়ীতে কমলার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এখানকার কমলাচাষিরা বিভিন্ন সমস্যায় ভোগছেন। দ্রæততম সময়ে কমলা চাষিদের সমস্যা ও সম্ভাবনা বিষয়ে সেমিনারের আয়োজন করে পর্যায়ক্রমে তাদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করব।
২০০৭ সালের ৩ নভেম্বর তত্ত¡াবধায়ক সরকারের কৃষি, মৎস্য, বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা ড. সি এস করিমসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের উচ্চ পদস্থ অসংখ্য কর্মকর্তা জুড়ীর কমলা বাগান পরিদর্শন করেন।
ঢাকা, চট্রগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জুড়ীর কমলার প্রচুর চাহিদা রয়েছে। নানান প্রতিকুলতা সত্তে¡ও চাষিরা কমলা উৎপাদন করছেন। পরিপক্ক কমলা বাজারজাত করার উপযুক্ত সময় নভেম্বর মাস। কিন্তু এর আগেই স্থানীয় কমলা বিক্রি প্রায় শেষ পর্যায়ে। কেননা, দেশীয় কমলার মৌসুম শুরু হবার আগেই আমদানী করা ভারতীয় ও চীনা কমলায় বাজার সয়লাব হয়ে যাওয়ায় দেশীয় কমলার বাজার মার খায়। প্রতিযোগিতার বাজারে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার ভয়ে পরিপক্ক হওয়ার আগেই (কিচুটা কাঁচা অবস্থায়) চাষিরা কমলা বাজারজাত করে কম দামে বিক্রি করে দেন।
কমলা বাগানকে কেন্দ্র করে গবেষনার মাধ্যমে নিত্য নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন হচ্ছে। বেকারত্ব দুর করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সংশ্লিষ্ট লোকজনের আয় বৃদ্ধি, দারিদ্রতা দুর, জীবন-যাত্রার মান উন্নয়নে কমলা চাষ ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। এ এলাকায় এ খাতে বিনিয়োগ হলে মৌসুমী ফল ভিত্তিক শিল্প কারখানা এবং পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠার অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এমনিতেই শতশত পর্যটকের পদচারণায় জুড়ী উপজেলার কমলা বাগান গুলো মুখরিত থাকে। সরকারের সহযোগীতা পেলে জুড়ী উপজেলা তথা বৃহত্তর সিলেটে উৎপাদিত কমলা দেশের চাহিদা মিঠিয়ে বিদেশে রপ্তানীর সমুহ সম্ভাবনা রয়েছে।
সম্ভাবনাময় এ শিল্পে সরকারী-বেসরকারী বিনিয়োগ প্রয়োজন। দেশীয় কমলা উৎপাদনকারীদের স্বার্থে বিদেশী কমলা আমদানীর সময় অন্তত দেড় মাস পিছিয়ে দেয়া প্রয়োজন বলে স্থানীয়দের অভিমত।

লেখক : মঞ্জুরে আলম লাল, সাংবাদিক ও কলামিস্ট, জুড়ী