খালেদ মাসুদ, জুড়ী :: মহামারী করোনা ভাইরাস আজ পৃথিবী বির্পযস্ত। ধনী, গরিব,উচ্চ বর্ণ,নিম্ন বর্ণ,আস্তিক, নাস্তিক কেউ বাদ যাচ্ছে না।ধসে পড়েছে মহা প্রাচীর সমুহ।অকেজ হয়ে পড়েছে হালের সব পারমাণবিক অস্ত্র। কাজে আসছে না শক্তিশালী রাডার।বাধা দিতে পারছে না ডলার পাউন্ড ইউরো কিংবা আরব দিনার।
গত বছর চীনের উহান ডিসেম্বরে প্রথম করোনা ভাইরাস সংক্রামিত হতে জানা যায়। কিন্তু চীনের সরকার তা প্রথমে প্রকাশ করতে চায় নি।এনিয়ে অবশ্য রাজনীতি কম হয় নি।শুরুর দিকে যখন ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার খবর প্রকাশিত হওয়া শুরু করে তখন বিশ্বের অধিকাংশ দেশের কর্তৃপক্ষই সংক্রমণটিকে ততটা গুরুত্বের সাথে নেয়নি।কিন্তু ৬মাসে তা পৃথিবীকে ওলট পালট করে দেয়। যখন তা বৈশ্বিক মহামারীতে রুপ নেয় তখন সকল দেশ ভিন্ন পরিকল্পনা হতে নেয়।বন্ধ হয়ে যায় যোগাযোগ ব্যবস্থা।মানুষকে ঘরে থাকতে বাধ্য করা হয়।করোনা ভাইরাস যেনো আরেকটা বিশ্বযুদ্ধ।
প্রচুর মানুষকে আক্রান্ত করে বিশ্বের বৃহৎ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়াকে বৈশ্বিক মহামারী বলে।ইতিহাসের পৃথিবী অসংখ্য মহামারী কবলে পড়েছে।এসব প্রাণঘাতি ব্যাধির মধ্যে প্লেগ, জিকা ভাইরাস, ইবোলা, হলুদ জ্বর, কুষ্ঠরোগ, জল বসন্ত, কলেরা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, টাইফয়েড, হাম ইত্যাাদি।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, ২০১১ থেকে ২০১৭, এই সাত বছরে বিশ্বব্যাপী ১৩০৭টি মহামারির ঘটনা ঘটেছে। ভূতত্ত্ববিদ বিজ্ঞানিরা গবেষণা করে বলেছেন, ১০০ বছর পর পর প্রকৃতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়।
ভাইরাস আবিষ্কারের বহু আগে এই মহামারিতে শত শত জনপদ বিলুপ্ত হয়ে যায়। পৃথিবীর সব চেয়ে প্রাচীন সভ্যতার সাক্ষী মিসরীয় মমির গায়েও বসন্তরোগের চিহ্ন পাওয়া গেছে। মিসরের ফারাওরা বিশ্বকে এক সময় শাসন করত। তাদের ক্ষমতা ও বীরত্বে সারা দুনিয়া কাঁপতো। এই ফারাও নামক নৃপতি গোষ্ঠী ধ্বংস হয়েছে গুটি বসন্তে। থুকিডাইসিসের রচনা থেকে আমরা জানতে পারি, পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধ যখন সংগঠিত হয়ে ছিলো গ্রিক নগররাষ্ট্র এথেন্স ও স্পার্টার মধ্যে, তখন টাইপাস মহামারিতে এথেন্সের জনসংখ্যার দুই তৃতীয়াংশ মারা যায়, যার কারণে স্পার্টার জয়লাভ করা সম্ভব হয়েছিলো।এক সময় দুনিয়ার বাতিঘর বলা হতো রোমকে। ১৬৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মাত্র ১৫ বছরে সেই রোম জনমানব শূন্য হয়ে যায় গুটি বসন্তের কারণে। ফলে তখন রোমকে বলা হতো ভূতের নগরী। এমন কি গোটা রোমে বাতি জ্বালাবার মতো কোনো মানুষ ছিলো না। রাজপরিবারের সদস্যরাও এর প্রকোপ থেকে রেহাই পায়নি। বিখ্যাত রোমান সম্রাট ম্যার্কাস অরেলিয়াসের ভাই লুইসিয়াস ভেরাসও মারা যান। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০ এ। গ্রিসের ফুসফুস নামে খ্যাত এথেন্সে বসন্ত রোগে ৩০ হাজারের বেশি লোক মারা যায়, যা ওই শহরের ২০ শতাংশ মানুষ। এই রোগটি সংক্রামক। এছাড়া বাতাসের মাধ্যমেও ছড়ায়। ২৫০ খ্রিস্টাব্দে সাইপ্রিয়ানের প্লেগ মহামারি বিশ্বকে বিপর্যস্ত করে তোলে। এর পর পঞ্চম শতাব্দিতে একদিকে যুদ্ধ অপর দিকে মহামারি পরাক্রমশালী রোমান সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে দেয়। আবার ষষ্ঠ শতাব্দির প্রথমভাগে রোমান সাম্রাজ্যের পূর্ব অংশের সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ান রোমান সাম্রাজ্যকে আগের মতো প্রতাপশালী অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। বিউবনিক মহামারিতে তার মৃত্যুতে সেই সম্ভাবনাকে শেষ করে দেয়। পরবর্তীতে দুই শতাব্দিতে বিউবনিক প্লেগে প্রায় ১০ কোটি মানুষ মারা যায়। এই রোগ মধ্যপ্রাচ্য এশিয়া ও ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় ছড়ায়। এটাকে ইতিহাসের সব চেয়ে ভয়ংকর মহামারি হিসাবে দেখা হয়। মরা মানুষের দুর্গন্ধে আকাশ-বাতাস দূষিত হয়। পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ মারা যায়, পঞ্চম শতকে ইরাক, ইরান তথা মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে প্রায় দুই লক্ষ মানুষ মারা যায় প্লেগ রোগে। বলা হয় পার্সিয়ারের অর্ধেক মানুষ মারা যায় এই রোগে।৬০০ শতকের প্রথমার্ধে পুরো দুনিয়ায় ৪০% মানুষ মারা যায় প্লেগ রোগে। ৭৩৫ থেকে ৭৩৭ পর্যন্ত এই দুই বছরে জাপানে এক তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায়। একই সময় প্লেগ রোগে বাইজানটাইন সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়।
১৬ শতকে ম্যাক্সিকোতে ৮০% লোক ও ইতালিতে ৩ লক্ষ প্লেগ রোগে মারা যায়। দুনিয়াব্যাপী, ইনফ্লুয়েঞ্জা, টাইফয়েড, অজানা রোগে ৯০% মানুষ মারা যায়। উনিশ শতকে ইনফ্লুয়েঞ্জা সারা দুনিয়া নাড়িয়ে দেয়। ১৩৩৪ সালে গ্রেট প্লেগাব লন্ডন হিসেবে স্বীকৃত প্লেগ আসে চীন থেকে। এরপর ইতালির ফ্লোরেন্স শহরেই মারা যায় ৬ মাসে ৯০ হাজার মানুষ। কয়েক বছরে এশিয়া ইউরোপে মারা যায় ৫ কোটি মানুষ। প্লেগের সৃষ্টি কোথা থেকে তার সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি। তবে আধুনিক বিজ্ঞানিরা বলছে, ইঁদুরের খাদ্য ও প্রসাব থেকে এই রোগটি হয়েছে। এই রোগটি সম্ভবত এশিয়ায় উৎপত্তি হয় এবং পরবর্তীতে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। এই মহামারির কবলে পড়ে ১৪শ শতাব্দিতে বিশ্বের জনসংখ্যা ৪৫০ মিলিয়ন থেকে ৩৫০-৩৭৫ মিলিয়নে নেমে আসে। পঞ্চদশ শতাব্দির শেষভাগে, ক্যারিবিয়ান দ্বীপ পুঞ্জে স্প্যানিশ বণিকরা নিয়ে আসে স্মল পক্স, বিউবনিক প্লেগ ও হামের মতো জীবাণু। ৯০ ভাগ আদিবাসী এই রোগে মারা যায়। ১৫১৯ সালে বর্তমান মেক্সিকোতে স্মল পক্স ছড়িয়ে পড়লে দুই বছরে মারা যায় প্রায় ৮০ লাখ মানুষ। ১৫২০ সালে ইউরোপিয়ানদের সাথে আসা একজন আফ্রিকান দাস স্মলপক্স নিয়ে আসলে গোটা এজটেক সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলছে, ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দিতে ইউরোপিয়ানদের বয়ে আনা জীবাণুর কারণে আমেরিকা মহাদেশের প্রায় ৫ কোটি ৬০ লাখ মানুষ মৃত্যু বরণ করেন। ১৬৩৩ সালে ফ্রান্স, গ্রেট বৃটেন ও নেদারল্যান্ডবাসীদের মাধ্যমে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসে স্পল পক্স ছড়িয়ে পড়ে। এতে প্রায় ২ কোটি মানুষ মারা যায় বলে দাবি করেন ইতিহাসবিদরা। ১৬৬৫ সালের ‘দি গ্রেট প্লেগ অব লন্ডন’-এ লন্ডনের জনসংখ্যার ২০ শতাংশ মৃত্যুবরণ করে। ১৭৯৩ সালে আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ায় ইয়েলো ফিভার মহামারি আকার ধারণ করে। এতে নগরের ১০ ভাগের একভাগ, প্রায় ৪৫ হাজার মানুষ মারা যায়। ১৮৫৫ সালের দিকে চীন, হংকংও ভারতে প্রায় দেড় কোটি মানুষ প্লেগে মারা যায়। ১৯১৮ সালে শুরু হওয়া স্প্যানিশ ফ্লুতে পৃথিবীতে মারা যায় ৫ কোটি মানুষ। মহামারির এ রকম বহু নিদর্শন পাওয়া যায় ইতিহাসে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে যুগে যুগে শত শত নগর-বসতি ধ্বংস হয়ে গেছে। তেমনি ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৭২০ সালে দুনিয়া জুড়ে ২০ কোটি মানুষ প্লেগ রোগে মারা যায়।
তার ১০০ বছর পর শুধু মাত্র ভারতে পূর্ব এশিয়ায় কলেরা রোগে মারা যায় লক্ষ লক্ষ মানুষ এবং আফ্রিকা ইউরোপে বসন্ত রোগে মারা যায় ৩৫ লক্ষ মানুষ। তার ও ১০০ বছর পর ১০২০ সালে দুনিয়া জুড়ে মারা যায় ৫ কোটি মানুষ। ১৮৬০ সালে আধুনিক যুগে প্লেগে চীন, ভারত ও হংকংয়ে ১ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ মারা যায়। পরে ১৮৯০ এর দশকে প্লেগের ভ্যাকসিন উদ্ভাবন হয়। বিশ শতকের সবচেয়ে বড় প্লেগ মহামারি দেখা দেয় ১৯১০ সালে। চীনের মাঞ্চুরিয়ায় দুই বছরের মারা যায় ৬০ হাজার মানুষ। বিশ্ব জুড়ে ১৯১৮ সালে গ্রেট ফ্লু মহামারি রূপ নেয়। এত দুই বছরে মারা যায় ৩ কোটির মতো মানুষ। ১৯১৮ থেকে ১৯১৯সাল সময়ে ইনফ্লুয়েঞ্জাতে বিশ্বব্যাপী মারা যায় প্রায় ৫ কোটি মানুষ। এ ভয়াবহ রোগকে তখন নাম দেওয়া হয় ‘স্প্যানিশ ফ্লু’। এটি ‘দ্য ইনফ্লুয়েঞ্জা প্যানডেমিক নামেও পরিচিত। গুটি বসন্ত বা স্মল পক্স ভ্যারিওলা ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হতো এবং এটি একটি মারাত্মক ব্যাধি ছিল। গুটি বসন্তের টিকা আবিষ্কৃত হয়ে ছিলো ১৭৯৬ সালে। অথচ টিকা আবিষ্কারের ২০০ বছর পরও এই রোগে হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে ভারতে। ১৯৭০ সালে লক্ষাধিক মানুষ রাতারাতি আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ১৯৭৫ সালে ভারত গুটি বসন্তমুক্ত ঘোষণা করতে সক্ষম হয়। আমেরিকায় ১৯৫২ সালে পোলিওতে আক্রান্ত হয় ৬০ হাজার শিশু। এতে তিন হাজারের বেশি মারা যায়। প্রথম এইচআইভি ভাইরাস শনাক্ত হয় ১৯৮৪ সালে। এই ভাইরাসের কারণে এইডস রোগে সে বছর আমেরিকায় মারা যায় ৫,৫০০ জন। বর্তমানে বিশ্ব জুড়ে ৩৫ মিলিয়ন মানুষ এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত। এ পর্যন্ত এইডসে মারা গেছে আড়াই কোটির মতো মানুষ।সার্স বা সিভিয়ার একিউট রেস্পিরেটরি সিনড্রোম এ ২০০২ সালের নভেন্বর থেকে ২০০৩ সালের জুলাইয়ের মাঝে ১৭টি দেশে ৭৭৮ মানুষের প্রাণ সংহার করেছিল। বিশ্ব জুড়ে ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু বা এইচ ওয়ান এন ওয়ান ফ্লুতে ১৮,৫০০ জন মারা গেছে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে এই রোগের মৃত্যুর সংখ্যা ৫ লাখ ৭৫ হাজার বলে ধারণা করা হয়। হাইতিতে ২০১০ সালে ভয়ংকর এক ভূমিকম্পের পর কলেরা মহামারি রূপ নিলে ১০ হাজার মানুষ মারা যায়। ২০১২ সালে ভাইরাসজনিত রোগে মারা যায় ২ লাখ ২২ হাজার মানুষ। সে বছর পুরো বিশ্বে ব্যাকটেরিযা সংক্রামক রোগ টিউবারকিউলোসিসে মারা যায় ১.৩ মিলিয়ন মানুষ। এছাড়া প্রতিবছর টাইফায়েড জ্বরে মারা যাচ্ছে ২ লাখ ১৬ হাজার মানুষ। জিকা ভাইরাস উগান্ডার জিকা ফরেস্ট এলাকায় বানরের মধ্যে ১৯৪৭ সালে ধরা পড়ে। ডেঙ্গু ২০১৯ সালে এশিয়ার কয়েকটি দেশে এডিস মশাবাহিত রোগ হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে ফিলিপাইনে প্রায় ৮০০ থেকে ৯০০ লোক মারা গেছে।
ইতিহাসের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক মহামারীগুলোর মধ্যে একটি ছিল ব্ল্যাক ডেথ (প্লেগ নামেও পরিচিত), যাতে ১৪ শতকে আনুমানিক ৭৫-২০০ মিলিয়ন মানুষ মারা গিয়েছিল।২০১০ এবং ২০১১ সালে বিশেষজ্ঞরা এই মহামারি’র শিকার হওয়া উত্তর ও দক্ষিণ ইউরোপের অধিবাসীদের ডিএনএন বিশ্লেষণ প্রকাশ করেন। এতে ইয়েরসিনিয়া পেস্টিস ব্যাকটেরিয়া’র (প্লেগ রোগ বিশেষ) জন্য রোগ সংক্রামক জীবাণু প্যাথোজেন’কে দায়ী করা হয়।মধ্য এশিয়ার সমভূমিতে এই রোগের উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়। এরপর এটি সিল্ক রোড হয়ে ১৩৪৩ সালের দিকে এটি ক্রিমিয়া পর্যন্ত পৌছায়। বণিকদের জাহাজে বসবাস করা ‘কালো ইঁদুর’ ও ‘ইঁদুর মাছি’ নামক দুইটি প্রজাতির মাধ্যমে এটি ভূমধ্যসাগর এবং ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।(চলবে)
[সুত্রঃ উইকিপিডিয়া, ইন্টারনেটে, ইত্তেফাক ]