সিজোফ্রেনিয়া হল এক প্রকার জটিল এবং দীর্ঘস্থায়ী মানসিক ব্যাধি। এই রোগে আক্রান্ত রোগীর চিন্তাধারা এবং অনুভূতির প্রকাশের মধ্যে সঙ্গতি থাকে না ৷ রোগী বাস্তবতার বোধ বা উপলব্ধি হারিয়ে ফেলে, প্রায়ই হ্যালুসিনেশনে ভোগে। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি সামাজিক বা কর্মক্ষেত্রে অক্ষমতাজনিত অসুবিধার সম্মুখীন হন ৷
আমাদের দেশে মানসিক রোগীর ঝাঁড়-ফুক, পানি পড়া, তেলপড়া, পানিতে চুবানো, শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা ও বিভিন্ন কবিরাজি চিকিৎসার শিকার হয়ে আসছে। তার মধ্যে বেশি কুসংস্কার ও অপচিকিৎসার শিকার হয় সিজোফ্রোনিয়া রোগীরা। সিজোফেনিয়া এক ধরনের গুরুতর মানসিক রোগ, কিশোর-কিশোরী, নারী-পুরুষ সবাই আক্রান্ত হতে পারে তবে ১৫-২৫ বয়সে বেশি হয়। রোগীরা বুঝতে পারে না কি তার সমস্যা, কেন ওষুধ খাচ্ছে, কেন ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে।
কীভাবে বুঝবেন আপনার আত্মীয় সিজোফ্রেনিয়ায় ভুগছে কি-না?
প্রধান লক্ষণ হলো
১. চিন্তার মধ্যে গণ্ডগোল।
২. আচরণের সমস্যা।
৩. অনুভূতির সমস্যা।
চিন্তার মধ্যে হরেক রকম অসংলগ্নতা দেখা দিতে পারে।
★ অহেতুক সন্দেহ করা
★ ভ্রান্ত বিশ্বাস করা
★ রোগীর মনের গোপন কথা না বললেও আশপাশের লোকজন জেনে যায়- কেউ কেউ তারের মাধ্যমে, ফোনের মাধ্যমে, টেলিস্কোপের মাধ্যমে অথবা অন্য কোনো অজানা যন্ত্রের মাধ্যমে জেনে যায়।
★ সে স্বপ্নের মধ্য দিয়ে উপর থেকে বিশেষ ক্ষমতা লাভ করছে আর তাকে নির্দেশ দিয়েছে মানুষের সেবা করার জন্য।
আচরণের সমস্যা
★ এই হাসছে আবার কোনো কারণ ছাড়াই কাঁদছে।
★ হঠাৎ উত্তেজিত হওয়া, মারতে উদ্যত হওয়া।
★ বকাবকি ও গালিগালাজ করা।
★ বাথরুমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা।
★ মানুষের সঙ্গে মিশতে না চাওয়া।
★ একা ঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ জাবনযাপন করা।
★ হঠাৎ করে কাপড় বা অন্য কিছুতে আগুন ধরিয়ে দেয়া।
★ আত্মহত্যার চেষ্টা করা।
★ উল্টাপাল্টা আচরণ করা ও কথা বলা।
★ গায়ের কাপড়-চোপড় সবার সামনে খুলে ফেলা।
অনভূতির সমস্যা
★ গায়েবি আওয়াজ শোনা : আশপাশে কোনো লোকজন নেই, অথচ রোগীরা কথা শুনতে পায়.
★ আবার কখন ফিসফিস আওয়াজ পাখির ডাকের মতো শব্দ শুনতে পায়।
★ নাকে বিশেষ কিছুর গন্ধ পাওয়া।
★ চামড়ার নিচে কি যেন হাঁটছে, এরকম অনুভূতি লাগা।
সিজোফ্রেনিয়ার শ্রেণীবিভাগ
সিজোফ্রেনিয়া বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে, যথা –
★ প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়া
★ হেবিফ্রেনিক সিজোফ্রেনিয়া
★ ক্যাটাটনিক সিজোফ্রেনিয়া
★ সিম্পল সিজোফ্রেনিয়া ইত্যাদি।
প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়া : এক্ষেত্রে, কোনও ব্যক্তির নির্দিষ্ট কিছু ভ্রান্ত বিশ্বাস বা ধারণা, বিভ্রান্তি থাকতে পারে, হ্যালুসিনেশন হয়, যার সাথে বাস্তবতার কোনও সম্পর্ক নেই।
হেবিফ্রেনিক সিজোফ্রেনিয়া : এর মূল বৈশিষ্ট্য হল, এতে আক্রান্ত রোগীরা অগোছালো চিন্তাভাবনা এবং বিশৃঙ্খল আচরণ করে।
ক্যাটাটনিক সিজোফ্রেনিয়া : এই ধরনের সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগী শারীরিকভাবে অদ্ভুত আচরণ করতে পারে।
সিম্পল সিজোফ্রেনিয়া : এক্ষেত্রে সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণগুলি হালকা হয় এবং উগ্রতা প্রদর্শন করে না। যেমন- দুর্বল স্বাস্থ্যবিধি এবং অন্যান্য ছোটখাটো শারীরিক ও মানসিক সমস্যা।
সিজোফ্রেনিয়ার কারণ
এই রোগের সঠিক কারণ জানা যায়নি। তবে, যে যে কারণগুলিকে এই রোগের জন্য দায়ী করা হয়, সেগুলি হল-
ক) জেনেটিক বা বংশগত এই রোগ থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও দেখা যায়। বাবা, মা-এর মধ্যে কারুর এই রোগ থাকলে সন্তানেরও হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
খ) ভাইরাস সংক্রমণ, মানসিকভাবে অত্যন্ত চাপগ্রস্থ পরিস্থিতি, ইত্যাদির কারণে এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
গ) মস্তিষ্কে রাসায়নিক উপাদানের ত্রুটি এবং নিউরোকেমিক্যাল উপাদানে কোনও ঘাটতি হলে এই রোগ হয়।
ঘ) জন্মকালীন কোনও জটিলতা থাকলেও এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
ঙ) গর্ভাবস্থায় কোনও মা যদি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয় তখন এই রোগ হতে পারে।
চ) কিছু উত্তেজক মাদকদ্রব্য এবং ওষুধ এই রোগের কারণ।
এই রোগের চিকিৎসা
এই রোগের লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এই চিকিৎসার প্রধান মাধ্যম হল অ্যান্টিসাইকোটিক ঔষুধ। এটি বিভিন্ন উপসর্গ কমাতে সাহায্য করে। এর পাশাপাশি, বিভিন্ন থেরাপি ও মনোচিকিৎসাও গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন মানসিক চিকিৎসা দ্বারা এর বিভিন্ন উপসর্গকে ভালো করা যায় এবং রোগীর সামাজিক সহায়তাও প্রয়োজন হয়।
এছাড়া, রোগীকে অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে তার মাথায় ইলেকট্রোড লাগানো হয় এবং ছোটো কারেন্টের শক দেওয়া হয়। এতেও রোগীর মানসিক অবস্থা এবং চিন্তার উন্নতি হয়…
লেখকঃ মারুফ খান শাহীন, শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়