গানের ভুবনে তিনি একজন সাধক। লক্ষ্য করলে দেখবেন, তাঁর যে গানগুলো খুব জনপ্রিয়, সেগুলো লিখিত হয়েছে জীব-পরম ভাবের উপর। আধ্যাত্মিকতার উর্বরভাব ভূমিতে। এই ভূমিতে দাড়িয়ে জীবনকে মনে হয় আশ্চর্য আনন্দময়। আনন্দলোকের এই দৃশ্যকল্পটি শ্রীচৈতণ্যের হাতে পাকা গাঁথুনি পেয়ে একদা বাংলা জয় করেছিলো। বাংলা থেকে ভূ-ভারতে সর্বত্র পৌছে যায় সেই ভাব। বুদ্ধ দর্শনের যোগ-সংযোগে স্বতন্ত্র এক বৈশিষ্ট্য নিয়ে অপরাজেয় লৌকিক দর্শনে রূপান্তরিত হয়। যাকে আমরা বাউল দর্শন বলি। বাংলার বাউলের দর্শন বাঙালির প্রাণের কথা অক্ষরে অক্ষরে ধারন করে। এই দর্শনের উপর ভিত্তি করে যেই গানই রচিত হোক, জাদুর মত প্রভাব ফেলে মানুষের মনে। শুনতে-গাইতে মানা করলেও প্রাণ নাঁচে অবচেতনে। নাঁচতে থাকা প্রাণের তাড়না বৈষয়িক জীবনে আবেগ ছড়ায়। আবেগে আপ্লুত বাঙালির প্রাণ গুনগুন করে গায় বাউলের রচিত মরমী গানের পদ।
মহাজগতের সাপেক্ষে জীবনকে সার্থক প্রতিপন্ন করার চেষ্টা থেকে মানুষ পরমের ভাবনা ভেবেছে। পরম সবাইকে ধারন করে আছে। পরম সবাইকে নিরন্তর পর্যবেক্ষণে রাখে। পরমের চোখ ফাঁকি দিয়ে কোনো মানুষ কর্ম-সাধন করতেই পারে না। পরম তার বিচারক, পরম তার নিয়ামক, পরমের সন্তুষ্টি তাকে সার্থক জীবনের তৃপ্তি এনে দেয়। পরম যদি ছিদ্রান্বেষী শাসকের মত সদা-সর্বদা ছড়ি ঘুরাতে থাকে, জীবনটাকে তখন অসহ্য মনে হবে। তাই পরমের সাথে হতে হবে আবগের তীব্র বিনিময়। আবেগে বশীভূত করে পরমকে রাখতে হবে বিভ্রান্ত করে। পরম খুব চতুর, বশীভূত করা এত সোজা নয়। সবাইকে খুঁচিয়ে অস্থির করে তোলে। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে পরম চলে যায় ভক্তের বাসরে। কুঞ্জ সাজানো পছন্দ না হলে পরম চলে যাবে অন্যদিকে অন্যের সাজানো কুঞ্জে।
ভাগবত-উপনিষদের বেদান্ত দর্শন পরমের সাথে মিলিত হবার প্রেরণা-দীপ্ত। ঘুরেফিরে সবকিছু, পরমেরই অংশ। পরম থেকে বিচ্ছিন্ন হলে সত্ত্বার নাম হয়ে যায় জীব। জীবের জীবন ক্ষণস্থায়ী। যতক্ষণ জীবন আছে ততক্ষণ সে কাটাবে হা-হুতাশ করে। সমুদ্র থেকে বিচ্ছিন্ন জল বাষ্প হয়ে আকাশে ভাসে, ঘন হয়ে মেঘের ফোঁটায় রূপ নিবে, অতপর বৃষ্টি হিসেবে ঝরে পড়ে আবার সমুদ্রে মিশবে। যতক্ষণ না সমুদ্রে ফিরে যেতে পারছে, ততক্ষণ তার ব্যগ্রতা-ব্যস্ততা সমুদ্রে ফিরে যাবার। জলের ফোঁটার এই আকুতিই জীবের আকুতি। প্রাণী কিংবা উদ্ভিদ অথবা মাটি-উপাদান-বস্তু, পরম থেকে বিচ্ছেদের ব্যথায় কাতর। বিচ্ছেদের এই বেদনা থেকে যে শিল্প সৃষ্টি হয়, সেটা আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া পায়। চেতন-গুরুর তীব্র চমকে সুরে ও ছন্দে কেমন গাঁথা হয়ে প্রকাশিত হয়। তাই সাধকের গান বৈষয়িক গানের মত নয়। সাধকের গান মানে জীবের আজন্ম আকুতি, আমরণ প্রত্যাশার মহাজাগতিক বিবৃতি।
রাধার সাথে তাঁর (পরম) এত দহরম-মহরম কেন? সবাইকে ছাড়িয়ে প্রেমের ভাবে রাধাই হয়েছে আশাতীত উত্তীর্ণ। বৈষ্ণব কবিদের এত যে কীর্তণ, বিরহ-মিলন পদ, জীবের জীবনের আকুতির প্রকাশ চিরন্তন ভাবের চর্চা সেসব।
বন্ধুরে কই পাবো সখী গো/ সখী আমারে বলো না/ বন্ধু বিনে পাগল এ মন বুঝাইলেও বোঝে না।
তোমরা কুঁঞ্জ সাজাও গো/ আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে।
বন্ধে মায়া লাগাইছে পিরিতি শিখাইছে, দিওয়ানা বানাইছে/ কি জাঁদু করিয়া বন্ধে মায়া লাগাইছে।
আমি কুল-হারা কলঙ্কিনী/ আমারে কেউ ছুঁইয়ো না গো সঁজনী।
কৃষ্ণ আইলা রাধার কুঁঞ্জে ফুলে পাইলা ভ্রমরা/ ময়ূর বেশে তে সাজুইন রাধিকা।
আব্দুল করিমের এই গানগুলো অসম্ভব জনপ্রিয়। বলা যায়, এমন কিছু গানই তাঁকে প্রচারের আড়াল থেকে দ্রুত সময়ের মধ্যে সর্বব্যপী প্রচারের আলোতে নিয়ে আসে।
রবীন্দ্রনাথের পরম-ভাবের কাছাকাছি হলেও বাউলের প্রকাশে ছেলেমানুষি বেশি। বাউলের গানে অতি আবেগে ভেসে যাবার প্রবণতা লক্ষণীয়। রবীন্দ্রনাথের প্রকাশভঙ্গীটি গম্ভীর। কিন্তু ভেতরের প্রাণটি একই। প্রাণের উচ্ছ্বলতা গোপন থাকতে পারে না। ভাষার খোলসে যতোই ঢাকা থাকুক, দুরন্ত প্রেমিক ঠিক কলকল করে উঠবে।
‘বঁধু, কোন আলো লাগলো চোখে’ কিংবা ‘তোমারও সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ’ ধরনের গানই রবীন্দ্রনাথের বেশি। একটা মানুষ সারা জীবন ধরে হাজার হাজার গান লিখে যাচ্ছে একই ভাবের উপর দাড়িয়ে, অথচ বৈচিত্রের কোনো কমতি চোখে পড়ে না। কারনটি শুধু ভাষাগত দক্ষতা নয়। ভাষাগত দক্ষতাটি রবীন্দ্রনাথের কম নয় কোনো অংশেই। কিন্তু জীবসত্ত্বা-মানবের চিরন্তন আকুতির ভূমিকাটি সবার আগে গণ্য। মানুষ আপন অন্তরের বাণী গীত হতে দেখে পুনঃপুনঃ নেঁচে ওঠে। একটু আগেই যে সে নেঁচে উঠেছিলো, সেটি আর মনে থাকে না। বাইরের তাগিদ অবচেতনে ভুল পড়ে যায়। ভেতর থেকে প্রাণ নাঁচে, তাই ঠোঁট-বুক আর অঙ্গসমূহ সচল হয়ে ওঠে।
আব্দুল করিমের গানে কথা এবং সুরের মুন্সিয়ানা প্রবল। অনেকটা লালন ফকিরের মতো। কথার ওজনে গানগুলো মানুষের হৃদয়কে বাইরে নিয়ে আসে আভিজাত্যের মোড়কে। গানের সুরে কথার জালে জড়িয়ে গিয়েও তার বৈষয়িক ঠাঁট অক্ষুন্ন থেকে যায়।
সুফিদের ভাবটি এই ধারার সাথে মিশ্রিত হয়েছে। সুফিদের ভাবের সাথে বৈষ্ণব-ভাবের খুব একটা তফাৎ চোখে পড়ে না। বিষয় বস্তু আলাদা হতে পারে কিন্তু দর্শনের ভিত্তি হুবহু। নির্দয় অভিভাবকের প্রতি ভক্তি আসে না। শিশু তার পিতাকে তখনি ভক্তি করবে, যখন তার পিতা প্রেমে বিগলনকে গুরত্ব দেবে। পিতার স্নেহ আর শিশুর ভক্তি মিলে যে যুগল বিনিময়ের মহাসড়ক নির্মিত হয়, সেই পথ ধরে অনন্ত আনন্দের স্রোত প্রবাহিত হয়। নিষ্ঠুর মানসিকতা সম্পন্ন পিতার প্রতি শিশুর ভীতি আর ঘৃণার উৎপাদন হয়। সেখানে কোনো আনন্দ নেই। নরকের জীবনে জীয়ন্তে তাপিত দশা হয়। পিতার কী ক্ষতি হচ্ছে, তা নির্ণয় জরুরী নয়। কিন্তু শিশুর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে মারাত্মকভাবে।
পরম হলো জীবের অভিভাবক, শাসক ও বিচারক। পরম যদি সর্বদা দণ্ড হাতে চোখ রাঙাতে থাকে, কথায় কথায় আগুনে পোড়াতে উদ্যত থাকে, জীব তাকে ভালোও বাসতে পারবে না, নিজের জীবনকেও উপভোগ করতে পারবে না। চেতনার প্রতিটি মুহূর্তকে মনে হবে নির্মম নিরানন্দের। অথচ জগতের অপর নাম আনন্দলোক। জীবের মৃত্যু হলে পরমের কাছে পৌছে যায়। পরম রয়েছেন অসীম আনন্দের পাত্র স্বরূপ। পরমের সাথে মিলিত হতে পারা মানে অনন্ত আনন্দের জগতে প্রবেশ করা। তাই পরপারের জীবনকে মরমী দর্শনে বলা হয় নিত্য (আনন্দ)ধাম। ইহাই জগতের ব্যর্থ জীবনের অধিকারী জীবের নিকট একমাত্র সান্ত্বনা। এই সান্ত্বনার স্বীকৃতি স্বরূপ পরমের ভাব-ভূমির ভিত্তিতে দাড়িয়ে জগতকে দেখার দর্শন থেকে সৃষ্টি হয় যে শিল্প-সঙ্গীত, তাই মানুষের কানে আরামের সুধা হয়ে ঢোকে। মানুষ নেঁচে ওঠে আপন অন্তরাত্মার সাথে।
আধুনিক কালের বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের গানে রয়েছে নিত্যধামের আনন্দ যাপনের মানসিক পরিতৃপ্তি এবং সান্ত্বনা। আপন প্রাণের ছন্দের সাথে গানের বাক্য মিলে গিয়ে ইপ্সিত সান্ত্বনার সফল রূপায়ণ ঘটে। অন্তরে লালন করা আকুতির বহিঃপ্রকাশ দেখে মুহূর্তেই একাত্ম হয়ে যায় সকল মানুষ-জন। কেউ কেউ দুরাচারে দুরাচারে আত্মাকে কলুষিত করে ফেলে, তারা দুর্ভাগা। সংখ্যায় অল্প হলেও ইহারাই পৃথিবীতে সকল নষ্টের গোড়া। নিত্য-অনিত্য, সকল প্রকার আনন্দ থেকে নিজেও বঞ্চিত থাকে, অপরকেও বঞ্চিত থাকতে প্ররোচিত করে। তাদের জন্য মরমী কবি হাসন রাজার বিখ্যাত একটি উক্তি-‘অপ্রেমিকে শুনবে না গান, দিলাম এ ফরমান’
সাধক-শিল্পী বাউল আব্দুল করিম ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের কালনী নদীর তীরে উজানধল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা এই মানুষটির শৈশব থেকেই একতারা ছিল নিত্যসঙ্গী। সঙ্গীতের প্রতি তাঁর ছিলো অসম্ভব অনুরাগ। জীবন কেটেছে সাদাসিধেভাবে। কোনও কিছুই তাঁর সঙ্গীতপ্রেমের পথে বাধা হতে পারেনি। হাওর পাড়ের সংগ্রামী মানুষটি বিশুদ্ধ বাঙালি হতে হতে হয়ে ওঠেন বাউল সম্রাট।
জীবনের বিভিন্ন সময় তিনি তালিম নিয়েছেন কমর উদ্দিন, সাধক রশিদ উদ্দিন, শাহ ইব্রাহীম মোস্তান বকশ এর কাছ থেকে। দীর্ঘ এ সঙ্গীত জীবনে বাউল ও আধ্যাত্মিক গানের পাশাপাশি ভাটিয়ালি গানও রচনা করেছেন তিনি।
লিখেছেন ১৬শ’র বেশি গান, সুর দিয়েছেন, যেগুলো ছয়টি বইয়ে গ্রন্থিত আছে। বাংলা একাডেমির উদ্যোগে তাঁর ১০টি গান ইংরেজিতে অনুদিত হয়েছে। শিল্পীর চাওয়া অনুযায়ী সিলেট বিভাগীয় কমিশনারের উদ্যোগে তাঁর সমগ্র সৃষ্টিকর্ম নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
একুশে পদকসহ বহু পদক পাওয়া এই মহান সাধক দীর্ঘদিন শ্বাসকষ্ট, কিডনির জটিলতা, ফুসফুসে ইনফেকশন এবং বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগে ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৯ খ্রি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী উজান ধল গ্রামে স্ত্রী সরলা বিবির কবরের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
লেখক: মাতুব্বর তোফায়েল হোসেন