• ৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ৫ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

কালের পরিক্রমায় জুড়ী; একটি পর্যালোচনা । শামসুল ইসলাম । পর্ব ০১

নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২০
কালের পরিক্রমায় জুড়ী; একটি পর্যালোচনা । শামসুল ইসলাম । পর্ব ০১

শামসুল ইসলাম :: মৌলভীবাজার জেলার অন্যতম একটি উপজেলা জুড়ী উপজেলা। প্রশাসনিকভাবে এই অঞ্চল উপজেলা হিসেবে ২০০৪ সালে স্বীকৃতি পেলেও বাণিজ্যিক, প্রাকৃতিক ও অবস্থানগত কারণে জুড়ী বৃটিশ আমল থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় তিন দিকেই ছোটছোট পাহাড় বেষ্টিত জুড়ী শহরের একদিকে দিগন্ত বিস্তৃত হাকালুকি হাওড় থাকায় এর প্রাকৃতিক পরিবেশ মনোমুগ্ধকর। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে নেমে আসা ছোট একটি স্রোত ধারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে জুড়ী শহরকে দুইভাগে বিভক্ত করে। উল্লেখ্য উক্ত নদীই পূর্বে কুলাউড়া ও বড়লেখা উপজেলার সীমানা ছিল।

জমিদারি আমলে  লংলা পরগনার কালেক্টর কামিনীবাবুর নাম অনুসারে কামিনীগঞ্জ এবং পাথারিয়া পরগনার কালেক্টর ভবানী বাবুর নাম অনুসারে ভবানীগঞ্জ নামে জুড়ী শহর আজও বিভক্ত। জুড়ী নদীর পাড়ে ঘাট বেঁধে সেখানে হাটবাজার গড়ে উঠায় এই নদীর নামানুসারেই এই অঞ্চলটি “জুড়ী” নামে প্রসিদ্ধ হয়ে যায়। 

বৃটিশ সরকার আসাম অঞ্চলে চা উৎপাদন শুরু করার প্রেক্ষিতে জুড়ী-কুলাউড়া-বড়লেখার সমস্থ চা বাগানের পন্য সরবরাহ করার সুবিধার্থে অবস্থানগত কারণে জুড়ী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। রেলপথ হওয়ার আগে কলকাতা বন্দর থেকে আসা সব মালামাল ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে নৌকায় জুড়ীতে এনে সেখান থেকে এই অঞ্চলের সব চা বাগানে সরবরাহ করা হতো। তখন থেকেই মূলত জুড়ী এই অঞ্চলের বাণিজ্যিক কেন্দ্র হতে শুরু করে। জুড়ী  এই অঞ্চলে চা’য়ের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়ার স্বাক্ষী হিসেবে কলেজ রোডস্থ অফিসার্স ক্লাব আজও  দাড়িয়ে আছে। বাগানের সকল শেতাঙ্গ বাবুরা প্রতি রবিবারে স্বপরিবারে এখানে প্রমোদ ফুর্তি করতে জড়ো হতেন। টেনিস, ব্যাডমিন্টন, পুল ইত্যাদি খেলাধুলা এবং নাচগান ও মদ্যপানের আসর বসতো এই ক্লাবে। সেদিন বিভিন্ন বিলাতি পণ্যের পসরাও বসতো সেখানে । ইংরেজ ছাড়াও স্থানীয় অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা এসব পণ্য ক্রয়ের সুযোগ পেতেন।আসামের চা উৎপাদনকারীদের দাবীর প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে একটি রেলপথ সংযোগের জন্য  আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে ১৮৯১ সালে বঙ্গের পূর্বাঞ্চলে রেলওয়ে ট্র‍্যাক নির্মাণ শুরু করে। সেই ধারাবাহিকতায় আখাউড়া-কুলাউড়া-বদরপুর অংশ ১৮৯৬-৯৮-এ চালু করা হয়। তখন যোগাযোগ সুবিধার কারণে জুড়ী আরো অগ্রসর হয়ে ওঠে। ঢাকা কলকাতা থেকে পন্য পরিবহন করে জুড়ীতে নিয়ে আসতেন ব্যবসায়ীরা।

করিমগঞ্জ থেকেও পণ্য পরিবহন করা সহজ ছিল। তাছাড়া প্রাকৃতিক সম্পদেও জুড়ী অত্যন্ত সমৃদ্ধ।  প্রচুর পরিমাণে কাঠ ও বাঁশ থাকায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা জুড়ীতে আগমন করতেন। দেশের কাগজ তৈরীর কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত মুলিবাঁশের চাহিদা পুরণে জুড়ীর বাঁশমহালগুলোর ভূমিকা কম নয়। এই বাঁশমহালগুলো জুড়ীর আর্থ সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে। বাঁশমহালের ইজারাদার বা মহালদারগণের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিলেন মরহুম মনোহর আলী (মনু মিয়া মহাজন),  মরহুম হাজী ইনজাদ আলী, মরহুম আপ্তাব উদ্দীন মহালদার এবং মরুহুম এম এ মুমিত আসুকসহ আরো অনেক সফল ব্যবসায়ী। বাঁশমহালের ব্যবসা ছাড়াও মনোহর আলী একজন প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার ছিলেন। সেই সময়ে এতদঞ্চলের সকল রাস্তাঘাট ও সরকারী স্থাপনার অধিকাংশই তাঁর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নির্মিত। একজন সফল ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক হিসেবে তিনি পরিচিত । জুড়ী শহরে বিশাল একটি কমপ্লেক্সে মসজিদ, মাদরাসা, ঈদগাহ এবং কবরস্থান প্রতিষ্ঠা করে একজন দানশীল ব্যক্তি হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। 

হাজী ইনজাদ আলীও জুড়ীর বিখ্যাত সফল ব্যবসায়ী ছিলেন। তাঁর সমাজসেবা ও বদান্যতা এই অঞ্চলে প্রবাদপ্রতিম হয়ে আছে। কথিত আছে তিনি যখন যাকাত দিতেন তখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ আসতো। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও কুলাউড়া ডিগ্রী কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন সর্বোচ্চ দাতা হিসেবে তাঁর নাম আজও লিপিবদ্ধ আছে।  তাঁর পরিবার জুড়ীর অন্যতম প্রভাবশালী পরিবার। আশির দশকে একই সাথে তাঁর ভাতিজা আসাদ উদ্দীন বটল উপজেলা চেয়ারম্যান এবং দুই পুত্র কমর উদ্দীন এবং মঈন উদ্দীন মইজন এবং এক নাতি সালেহ আহমেদ  ইউনিয়ন চেয়ারম্যান নির্বাচিত  হয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। বিভিন্ন মসজিদ মাদরাসা ও স্কুল প্রতিষ্ঠা করে এই পরিবার আজো সমাজসেবার সাথে জড়িত আছে। 


মরহুম আপ্তাব উদ্দীন মহালদারও জুড়ীর পরিচিত এক ব্যবসায়ী।  তাঁর এক ছেলে মরহুম জালাল উদ্দীন একজন প্রভাবশালী নেতা এবং  ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ছিলেন। বর্তমানে তাঁর আরেক ছেলে নাসির উদ্দিন আহমেদ মিঠু  একজন শিল্পপতি এবং জুড়ী-বড়লেখা আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী।  এই পরিবার থেকেও একটি কলেজ প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজ করা হয়েছে। 


এম এ মুমিত আসুক জুড়ীর একজন সফল ব্যবসায়ীর পাশাপাশি একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। বারবার ইউনিয়ন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর নবগঠিত জুড়ী উপজেলার প্রথম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। পরবর্তী মেয়াদে আবার নির্বাচিত হলেও কিছুদিন পরে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পরে উপনির্বাচনে আবার তাঁর সহধর্মিণী নির্বাচিত হন। বর্তমানে তাঁর সহোদর বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ মুঈদ ফারুক উপজেলা চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্বরত আছেন। তার আরেক ভাই এম এ মুহাইমিন সালেহ দেশের প্রখ্যাত ট্রাভেলস ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি এসোসিয়েশন অব ট্র‍্যাভেল এজেন্ট অব বাংলাদেশ (আটাব) এর চেয়ারম্যান ছিলেন। এই পরিবারও অনেক মসজিদ, মাদরাসা,স্কুল, কলেজ প্রতিষ্ঠা করে সমাজসেবায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

বাণিজ্যিকভাবে অনেকটা সমৃদ্ধ থাকলেও রাজনৈতিকভাবে জুড়ী কুলাউড়া -বড়লেখার মত অগ্রসর হতে পারেনি। এর অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে প্রশাসনিক বিভক্তি। উপজেলা ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত জুড়ীর রাজনীতি কুলাউড়া এবং বড়লেখা কেন্দ্রিক ছিল। একই শহরের পূর্ব এবং পশ্চিম পাড়ে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক চর্চা হতো। একই শহর বা অঞ্চলের নেতাকর্মীরা যখন বিভক্ত রাজনীতি করছেন, এমনকি যখন একই স্কুল-কলেজে পড়েও ছাত্ররা দুই উপজেলা কেন্দ্রীক রাজনীতি করছেন, তখন সেখান থেকে যোগ্য নেতৃত্ব উঠে আসা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে জুড়ীর রাজনৈতিক অঙ্গন অনেক সমৃদ্ধ ছিল।

তখন আওয়ামীলীগ ছাড়াও মুসলিমলীগ, ন্যাপসহ অনেক রাজনৈতিক দল জুড়ীতে ভালো অবস্থানে ছিল। আওয়ামীলীগ নেতা মরহুম তৈমুছ আলীর নেতৃত্বে জুড়ী-বড়লেখা অঞ্চলের আওয়ামী রাজনীতি তখন তুঙ্গে ছিল। তৈমুছ আলী বঙ্গবন্ধুর খুব আস্থাভাজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ১৯৭০ সালের ২৮  নভেম্বর বঙ্গবন্ধু জুড়ীতে আগমন করে তৎকালীন পোস্ট অফিস রোড সংলগ্ন রেল স্টেশনের কাছে জনসভায় হাজার হাজার মানুষের সামনে তৈমুছ আলীকে আওয়ামীলীগের মনোনীত প্রার্থী হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেন। কথিত আছে বঙ্গবন্ধু তাঁর  মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন ” এই হচ্ছে আমার পাগল, আপনারা আমার পাগলকে দেখে রাখবেন”। সত্তরের নির্বাচনে তিনি সিলেট ১২ আসন (বড়লেখা) থেকে এমপিএ নির্বাচিত হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা অত্যন্ত  সাহসিকতার সাথে মুক্তি সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর  প্রতিক্রিয়াশীল চক্র তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে বারবার আক্রমণ করে। অবশেষে ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ তাঁর জুড়ী শহরস্থ বাসভবনের সামনে তাঁকে শহীদ করা হয়। তৈমুছ আলী হত্যার পর থেকেই জুড়ীতে রাজনৈতিক চর্চার অবনতি হতে থাকে। অজানা কারণে দীর্ঘদিন এই সৎসাহসী নেতার  স্মৃতি ও অবদানকে ধরে রাখার মত কোন রাজনৈতিক উদ্যোগ নেয়া হয়নি। জুড়ী উপজেলা হওয়ার পর জুড়ী-বড়লেখা আসনের আওয়ামিলীগ মনোনীত সংসদ সদস্য শাহাব উদ্দীন আহমদ মরহুম তৈমুছ আলীর স্মৃতি ও অবদানকে তুলে ধরার ব্যাপারে উদ্যোগী হোন। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তিনি এই বীর মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিকে শ্রদ্ধার সাথে তুলে ধরেছেন। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দীর্ঘ ৪৪ বছর পর এই মহান নেতার স্মৃতির ধরে রাখার জন্য ” তৈমুছ আলী টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ ” প্রতিষ্ঠা করা হয়। জুড়ীর একজন রাজনৈতিক নেতার স্মরণে এমন একটি প্রতিষ্ঠান জুড়ীর রাজনৈতিক অঙ্গনের জন্য একটি বড় অর্জন।  এজন্য মাননীয় মন্ত্রী জনাব শাহাব উদ্দীনের প্রতি জুড়ীবাসী কৃতজ্ঞ থাকতে হবে।
চলবে……

September 2024
S S M T W T F
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930