সিলেটে পুলিশ হেফাজতে রায়হানের মৃত্যুর ঘটনায় নির্যাতনের বিষয়ে প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি। নগরীর বন্দরবাজার ফাঁড়ি ইনচার্জ আকবর হোসেনের নেতৃত্বে এ নির্যাতন চালানো হয়।
ইনচার্জসহ ৭ পুলিশ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য মিলেছে। এ ঘটনায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ (এসএমপি)। সোমবার আকবরসহ ৪ পুলিশকে সাময়িক বরখাস্ত এবং ৩ জনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
রোববার রায়হানের মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে এসএমপির উপকমিশনার (ডিসি-উত্তর) আজবাহার আলী শেখের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন : এসএমপির অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি ক্রাইম দক্ষিণ) এহসানুদ্দিন চৌধুরী, এডিসি ক্রাইম উত্তর শাহরিয়ার আল মামুন ও সহকারী কমিশনার (এসি এয়ারপোর্ট) প্রভাশ কুমার সিং।
কমিটির একটি সূত্র জানায়, সোমবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বন্দর ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ সে সময় দায়িত্বে থাকা ৭ পুলিশ সদস্যকে। ইনচার্জ আকবর প্রথমে রায়হানকে ফাঁড়িতে নেয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। পরে সিলেট পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে তদন্ত কমিটি। সেই ফুটেজ দেখানোর পর সবাই মুখ খুলতে শুরু করেন।
ফুটেজে শনিবার রাত ৩টা ৯ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডে দেখা যায়, দুটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা এসে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে এসে থামে। সামনের অটোরিকশা থেকে তিন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে রায়হানকে দেখা যায়। তিনি হেঁটে হেঁটেই পুলিশের সঙ্গে ফাঁড়িতে প্রবেশ করেন। এর প্রায় তিন ঘণ্টা পর সকাল ৬টা ২২ মিনিটে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা আসে বন্দর ফাঁড়ির সামনে। এর দুই মিনিট পর ৬টা ২৪ মিনিট ২৪ সেকেন্ডে দুই পুলিশের কাঁধে ভর করে রায়হানকে সেই অটোরিকশায় তুলতে দেখা যায়।
ইনচার্জ আকবরসহ অন্যরা তদন্ত কমিটিকে জানান, শনিবার রাত আড়াইটার দিকে দু’জন লোক সোবহানীঘাট থেকে কাস্টঘর রোড দিয়ে যাচ্ছিল। পথে সুইপার কলোনির গেটের পাশে তাদের আটক করে ছিনতাইকারীরা। চাকু দিয়ে টাউজারের পকেট কেটে তাদের টাকা-পয়সা নিয়ে পাশের সুইপার সুলাইলালের ঘরে ডুকে যায় তিন ছিনতাইকারী। এরপর ছিনতাইয়ের শিকার লোকজন মহাজনপট্টি দিয়ে বের হয়ে নগরীর বন্দরবাজারের মশরাফিয়া রেস্টুরেন্টে দুই পুলিশকে (কোতোয়ালি থানার মুন্সি ও এক অপারেটর) নাশতা করতে দেখে।
তারা পুলিশকে ছিনতাইয়ের বিষয়টি জানায়। পুলিশ ইকো-১-কে মোবাইলে কল দিয়ে এ খবর জানায়। এরপর ইকো-১-এর ওয়্যারলেস অপারেটর কনস্টেবল আবু তাহের এএসআই আশিক এলাহীর টিমকে খবর পাঠায়। টিমের অন্য সদস্যরা হলেন : কনস্টেবল তৌহিদ মিয়া ও হারুনুর রশিদ। তারা গিয়ে ঘটনাস্থল থেকে ভিকটিমের উপস্থিতিতে রায়হানকে আটক করে। তার সঙ্গে থাকা দু’জন দৌড়ে পালিয়ে যায়।
পরে রায়হানকে ফাঁড়িতে নিয়ে আসা হয়। এ সময় এএসআই আশিক এলাহী ছিনতাইয়ের শিকার লোকের নাম-পরিচয় রাখেননি বলে তদন্ত কমিটিকে জানান। ইনচার্জ আকবর চুপ থাকলেও আটককারী সদস্যরা কমিটিকে জানান, ফাঁড়িতে নিয়ে আসার পর এসআই আকবরের নেতৃত্বে রায়হানকে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। তার নির্দেশেই তৌহিদের ফোনে রায়হান তার মায়ের সঙ্গে কথা বলে ১০ হাজার টাকা নিয়ে আসতে বলেন।
এ ঘটনায় সোমবার বিকালে ফাঁড়ি ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত ও তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়। তদন্ত কমিটির প্রধান ও এসএমপির উপকমিশনার (ডিসি উত্তর) আজবাহার আলী শেখ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, ঘটনার পর থেকে প্রাথমিক তদন্তের ফলাফল বিশ্লেষণ করে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে এক আদেশে চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত ও তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়। বরখাস্ত হওয়া অন্য তিনজন হলেন : কনস্টেবল তৌহিদ মিয়া, টিটু চন্দ্র দাশ ও হারুনুর রশীদ। আর প্রত্যাহার করা তিনজন হলেন : এএসআই আশেক এলাহী, কুতুব আলী ও কনস্টেবল সজীব হোসেন।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, বরখাস্ত ও প্রত্যাহার করা সাত পুলিশ সদস্যকে নিয়ে আরেক দফা তদন্ত চলছে। এই তদন্তের পর এদের মধ্য থেকে রায়হান হত্যা মামলায় আসামি করা হতে পারে।
শনিবার রাতে রায়হানকে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে ১০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করে পুলিশের কয়েকজন সদস্য। ফোনে পরিবারের সদস্যদের টাকা নিয়ে আসতে বলেন রায়হান। রোববার সকালে ৫ হাজার টাকা নিয়ে তার পরিবারের সদস্যরা থানায় গিয়ে জানতে পারেন, অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সেখানে গিয়ে শোনেন রায়হান মারা গেছেন।
পুলিশের পক্ষ থেকে প্রথমে বলা হয়েছিল, নগরীর কাস্টঘর এলাকায় ছিনতাইয়ের চেষ্টাকালে গণপিটুনিতে রায়হানের মৃত্যু হয়েছে। তবে সোমবার দিনভর ওই এলাকায় অনুসন্ধানে এমন কোনো ঘটনার তথ্য পাওয়া যায়নি। সেখানে যেসব সিসি ক্যামেরা আছে, তাতেও এরকম কোনো ঘটনার রেকর্ড নেই। তবে রায়হানকে যে ধাওয়া করে একটি কক্ষ থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তা নিশ্চিত করেছেন সেই ঘরের মালিক সুইপার সুলাইলাল।
তিনি এদিন দুপুরে যুগান্তরকে জানান, শনিবার রাত ৩টার দিকে হঠাৎ দৌড়ে আসে রায়হানসহ দু’জন। একজন অন্যদিকে দৌড়ে চলে গেলেও রায়হান তার ঘরে প্রবেশ করেন। তারপর দরজা বন্ধ করে দেন। এর কিছুক্ষণ পর ৬ জন পুলিশ এসে তাকে বলে, তার ঘরে একজন ছিনতাইকারী প্রবেশ করেছে। তখন তিনি পুলিশের কাছে স্বীকার করেন। সুলাইলাল বলেন, পুলিশ আমার ঘর থেকে রায়হানকে সুস্থ অবস্থায় হ্যান্ডকাপ পরিয়ে নিয়ে যায়।
রায়হানকে হত্যার অভিযোগে রোববার রাত আড়াইটায় কোতোয়ালি থানায় মামলা করেছেন নিহত রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে থানার এসআই আবদুল বাতেনকে। এর আগে এসএমপির উপকমিশনার (ডিসি-উত্তর) আজবাহার আলী শেখ স্বাক্ষরিত ৬৩৫৭নং স্মারকে বলা হয়: রায়হানের স্ত্রীর অভিযোগ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কে বা কারা তার স্বামীকে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে নিয়ে পুলিশি হেফাজতে রেখে তার হাত-পায়ে আঘাত করে জখম করে।
ফাঁড়িতে রাতভর নির্যাতনের ফলে তার স্বামী মারা যান। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কোতোয়ালি থানার ওসিকে নির্দেশ দেন আজবাহার আলী শেখ। এ বিষয়ে একটি চিঠিও যুগান্তরের হাতে এসেছে।
এদিকে সোমবারও রায়হান হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে স্বজন ও স্থানীয়রা সিলেটে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছেন। বিকাল ৩টা থেকে ঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠিত এ মানববন্ধনে বিক্ষোভকারীরা আলটিমেটাম দিয়ে বলেন, ৭২ ঘণ্টার ভেতর রায়হানের হত্যাকারীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তা না হলে কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচি দেয়া হবে।