আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় আর আট দশটি পন্যের মত সংবাদও একটি পন্য। সংবাদকে জনপ্রিয় করার ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ ও তার ইতিহাস। সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতার পরিবর্তে নজরকাড়া শিরোনামের সাথে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ভিত্তিহীন, চটকদার ও সত্যের সাথে মিথ্যা মিশিয়ে পরিবেশনই হচ্ছে হলুদ সাংবাদিকতা। সংবাদকে পন্যকরনের ইতিহাসের সাথে সংবাদ জগতের দুই মহারথির নাম জড়িয়ে আছে। পত্রিকার কাটতি বাড়াতে এই দু’জনের নষ্ট প্রতিযোগিতা জন্মদিয়েছে সংবাদ জগতের সাথে পরিচিত একটি শব্দ ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ বা ‘ইয়োলো জারনালিজম’। আজকের লেখায় চলুন পরিচিতহই এর বিস্তারিত ইতিহাসের সাথে।
আমেরিকার সংবাদপত্র জগতের দুই মহারথি ‘জোসেফ পুলিতজার’ এবং ‘উইলিয়াম র্যান্ডলফ হারস্ট’ এর পত্রিকার বিক্রি বাড়ানোর জন্য ইতিহাসে প্রথমবারের মত তারা শুরু করে মনগড়া, ভুয়া, অর্ধসত্য ও চটকদার শিরোনামে সংবাদ পরিবেশন। তাদের এই ইতিহাস বিখ্যাত দ্বৈরথের গল্প জানার আগে চলুন এ দুজনের সাথে আলাদাভাবে পরিচিত হই।
জোসেফ পুলিতজারঃ আমেরিকার সংবাদ ও প্রকাশনা জগতের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তার নাম। সাধারণ মানুষের দুঃখ দুর্দশার গল্প, অভিজাত সমাজের বৈষম্য, ক্ষমতাশীলদের দুর্নীতির কথা তার লেখায় সাহসিভাবে ফুটিয়ে তুলে যেভাবে সুনাম কামিয়েছেন। তেমনিভাবে উইলিয়াম র্যান্ডলফ হারস্ট এর সাথে পত্রিকার বিক্রি বাড়াতে ভুয়া, চটকদার সংবাদ প্রকাশের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মেতে যথেষ্ট দুর্নামও কামিয়েছেন। হাঙ্গেরির একটি ছোট শহরে জন্ম নেয়া জোসেফ পুলিতজার শৈশবেই আমেরিকায় অভিবাসি হিসেবে পাড়ি জমান। সেসময় ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে জাহাজে করে প্রতিদিন হাজার হাজার লোক সচ্ছলজীবনের স্বপ্ন নিয়ে আমেরিকায় অভিবাসন করছিলো। তখন থেকেই মূলত আমেরিকার নিউইয়র্ক শহর সারাবিশ্বের অভিবাসনকামি মানুষের প্রধান পছন্দের শহর হয়ে উঠতে শুরু করেছিলো। শৈশবে পুলিতজার একজন ‘নিউজি’ (যে বাচ্চারা পত্রিকা হাতে নিয়ে হেঁটে হেঁটে বিক্রি করতো) হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। সাংবাদিকতার উপর তার আগ্রহটা তখন থেকেই। আর তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতেন নিজে একটি পত্রিকা করবেন। ১৮৮৩ সালে পুলিতজার সেইন্ট লুইস পোস্ট নামে একটি পত্রিকায় সাংবাদিকতার সুযোগ পান। সঠিক তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে অল্পদিনেই পুলিতজার সাংবাদিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান। এর কিছুকাল পরে ‘সেইন্ট লুইস ডিসপ্যাচ’ নামে প্রথম একটি পত্রিকার মালিক হন পুলিতজার। তারপর সেইন্ট লুইস থেকে পুলিতজার নিউইয়র্ক শহরে চলে আসেন। সেখানে ‘নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ড’ নামে একটি পত্রিকা কিনে নেন। আমেরিকার সংবাদপত্রগুলো তখন সবাই একইরকম সংবাদ উপস্থাপন করতো। সমাজের উচু শ্রেণির মানুষের কর্মকাণ্ডের শিরোনামহীন সব সংবাদ ছাপা হত। যা ছিল বেশ একঘেয়ে। পুলিতজারই প্রথম বড় অক্ষরের শিরোনামযুক্ত, বোল্ড, টাইপোগ্রাফিসহ বিভিন্ন রকম অক্ষরে সংবাদ প্রকাশ করেন। যা অল্পদিনেই বেশ আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। মাত্র ছয় মাসের মাথায় তার পত্রিকার গ্রাহক তিনগুন বেড়ে পঞ্চাশ হাজারে পৌছায়। আর দেড় বছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় এক লাখে। আর এভাবেই জোসেফ পুলিতজারের উত্থান শুরু হয়।
উইলিয়াম র্যান্ডলফ হারস্টঃ নিউ ইয়র্ক থেকে দুইশ মাইল দূরে ম্যাসেচুসেটস এর কেমব্রিজে বসে পুলিতজারের এই উত্থান খুব সুক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন উইলিয়াম রান্ডলফ হারস্ট। ধনী পরিবারের প্রাচুর্যে বেড়ে ওঠা হারস্ট ছোটবেলা থেকেই ছিলেন উচ্চাভিলাষী। পারিবারিকভাবে তারা সংবাদপত্র ব্যাবসায় জড়িত ছিল। ১৮৮৭ সালে হারস্ট তার বাবার পত্রিকা ‘সান ফ্রান্সিসকো এক্সামিনার’ এর দায়িত্ব নেন। বাজে ও নিম্নমানের সংবাদ পরিবেশনের কারণে পত্রিকাটির ছিল খুবই নাজেহাল অবস্থা। পুলিতজারের কৌশল অবলম্বন করে হারস্ট তার পত্রিকার নতুন রূপ দেন। মিথ্যা, বানোয়াট ও মুখরোচক সংবাদ ছাপিয়ে হারস্ট ও তার পত্রিকা অর্জন করে এক শ্রেনির সস্তা পাঠক সমাজ যারা ওই ধরনের মুখরোচক সংবাদই বেশী পছন্দ করে। মিথ্যা, বানোয়াট ও অসৎ উদ্দেশ্যে প্রণোদিত সংবাদ প্রচার করে উইলিয়াম হারস্টই প্রথম সংবাদ ইতিহাসের সাথে জড়িত কলংকিত অভিধা ‘হলুদ সাংবাদিকতা’র প্রচলন করেন। স্বীকৃতি ও ক্ষমতার মোহে যার নষ্ট ফাঁদে জড়িয়ে যুগেযুগে এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছেন কেউ না কেউ সবসময়। এরপর হারস্টও নিউইয়র্ক চলে আসেন তার আদর্শগুরু পুলিতজারের সাথে মুখোমুখি প্রতিযোগিতায় নামতে। এরপরেই শুরু হয় হলুদ সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্র ইতিহাসের একইসাথে কুখ্যাত ও বিখ্যাত এই দ্বন্দের যা আমরা সংক্ষেপে আলোচনা করবো।
পুলিতজার বনাম হারস্ট যুদ্ধঃ পুলিতজার ও হারস্টের মধ্যে বিশেষ একটি মৌলিক পার্থক্য ছিল পুলিতজার ক্ষমতার প্রতি আগ্রহী ছিলেন একটি বিশেষ পরিবর্তনের জন্য। তিনি চেয়েছিলেন খেটে খাওয়া মানুষদের তাদের অধিকার আদায়ে সচেতন করতে। অন্যদিকে উইলিয়াম হারস্টের চাওয়া ছিল সবসময় আত্মউন্নয়ন ও প্রভাবশালী সমাজে আরও প্রভাব অর্জন করা। হারস্ট নিউ ইয়র্ক এসে ‘নিউ ইয়র্ক মর্নিং জার্নাল’ নামের একটি সস্তা পত্রিকা কিনে নেন। ঠিক সেই সময় পুলিতজার পরিবারের সাথে নিউ ইয়র্কের বাইরে অবস্থান করায় উইলিয়াম হারস্ট মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে পুলিতজারের পত্রিকার বেশ কিছু সেরা সাংবাদিককে নিজের পত্রিকায় নিয়ে আসেন। তার পত্রিকার নতুন নাম দেন ‘নিউ ইয়র্ক জার্নাল’। এ পত্রিকার প্রথম পাতায় বড় বড় শিরোনামে সংবাদগুলো থাকতো মূলত অপরাধ ও স্ক্যান্ডাল জাতীয় বিষয়ে ভরপুর। এর ফলে মাত্র তিন মাসে হারস্টের পত্রিকা দ্বিগুণ গ্রাহক অর্জন করে। প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে হারস্ট তার পত্রিকার দামও কমিয়ে দেন। পুলিতজারের ৮ পৃষ্ঠার পত্রিকা ‘নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ড’এর দাম ছিল যেখানে ২ সেন্ট, সেখানে হারস্ট তার ১৬ পৃষ্ঠার ‘নিউ ইয়র্ক জার্নাল’এর দাম ধরেন মাত্র ১ সেন্ট। এর ফলে পুলিতজারের পত্রিকার গ্রাহক হারাতে শুরু করে। হারস্টের এই কুট কৌশলে পুলিতজার মানসিকভাবে মারাত্মক আহত হন। হারস্টের নিত্যনতুন ধূর্ত বুদ্ধির কাছে বারবার পরাহত হতে থাকে পুলিতজার ও তার পত্রিকা। পুলিতজারের পত্রিকায় কাজ করা সেসময়ের সেরা সাংবাদিক ছিলেন আরথার ব্রিজবেন। আর সেরা কার্টুনিস্ট ছিলেন রিচারড ফেন্টো। ফেন্টো নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ড এর প্রথম পাতায় নিয়মিত ‘ইয়োলো কিড’ বা ‘হলুদ বালক’ নামে একটি কার্টুন আঁকতেন। এই কার্টুনের মাধ্যমে পুলিতজার সমাজের অসঙ্গতি থেকে শুরু করে অনেক কিছু প্রকাশ করতেন যা খুব জনপ্রিয় হয়। তারপর পু লিতজারের পত্রিকার এই দুই তারকা সাংবাদিককে উইলিয়াম হারস্ট মোটা অঙ্কের বেতনের প্রলোভনে নিজের পত্রিকায় নিয়ে নেন। তখন পুলিতজার বাধ্য হয়ে জর্জ লুকাস নামে আরেক কার্টুনিস্টকে নিয়োগ দেন। এরপর থেকে উভয় পত্রিকাতেই ছাপা হতে লাগলো ‘ইয়োলো কিডস’ কার্টুন। এই হলুদ বালক কার্টুনের মাধ্যমে ছাপা হওয়া ভিত্তিহীন, অর্ধসত্য, উদ্দেশ্য প্রণোদিত সংবাদ তখন থেকেই ‘ইয়োলো জারনালিজম’ বা ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ হিসেবে পরিচিতি পায়। এর ফলে তৈরি হয় নষ্ট মানসিকতা সম্পন্ন এক পাঠক শ্রেণির। যারা সবসময় চটকদার, ভিত্তিহীন, অর্ধসত্য সংবাদ পাঠ করে তৃপ্তি পেত। ১৮৯৮ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি কিউবার হাভানায় নোঙ্গর করা একটি আমেরিকান মেরিন জাহাজে আকস্মিক বিস্ফোরণে প্রায় আড়াইশো জন নাবিক মারা যায়। উইলিয়াম হারস্ট এই খবরকে তার পত্রিকায় স্পেনের ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করে ভুয়া তথ্যে ভরপুর করে উত্তেজনামুলক সংবাদ প্রকাশ করে। এই তথ্যের ভিত্তিতে ওই সংবাদ প্রকাশের দুইমাস পর ১৮৯৮ সালের ২৫শে এপ্রিল আমেরিকা স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তখন বাজারে টিকে থাকার লড়াইয়ে পুলিতজারও হারস্টের মত ভুয়া সংবাদ প্রকাশ করতে শুরু করে। স্পেনিশ আমেরিকান যুদ্ধ হারস্ট ও পুলিতজার উভয়ের পত্রিকার জন্যই একটি লাভজনক বাজার তৈরি করেছিল। এ সময়েই হারস্টের পত্রিকার নিয়মিত গ্রাহক সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যায়।
তখনকার সময়ে গ্রাহকদের কাছে দৈনিক পত্রিকা পৌঁছে দিত পথশিশুরা। তাদেরকে ‘নিউজি’ বলে দাকা হত। যুদ্ধকালীন সময়ে নিউজিরা একশটি পত্রিকা কিনত তৎকালীন ৫০ সেন্ট মূল্যে। এ অবস্থায় নিউ ইয়র্কের দুই বড় পত্রিকা মালিক পুলিতজার ও হারস্ট অধিক মুনাফার আশায় নিউজিদের বিপক্ষে কঠোর অবস্থানে যায়। নিউজিদের অবিক্রিত পত্রিকার মুল্যফেরত না দেয়া এবং তাদের জন্য একশটি পত্রিকার মুল্য নির্ধারণ করা হয় ৬০ সেন্ট। এমন পরিস্থিতিতে নিউজিরা পত্রিকা দুটির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামায় পত্রিকা দুটির বিলিব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে আমেরিকার দুই প্রভাবশালী পত্রিকার ব্যবসা তাদের মালিকের নিষ্ঠুরতার কারণে আচমকা হুমকির মুখে পড়ে। এক পর্যায়ে জোসেফ পুলিতজার তার কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনায় ভুগতে শুরু করেন। কারণ তিনি নিজেও একসময় নিউজি ছিলেন। অবশেষে দুই পত্রিকার মালিক নিউজিদের অবিক্রিত পত্রিকার টাকা ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে ১৮৯৯ সালের ২ আগস্ট ধর্মঘট শেষ হয়। সততার সাথে সাংবাদিকতা করে সুখ্যাতি অর্জন করা জোসেফ পুলিতজার অধিক মুনাফার লোভে পড়ে উইলিয়াম র্যান্ডলফ হারস্টের সাথে জঘন্য প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন। পরবর্তীতে নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ মিলিয়ন ডলার অনুদান করেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়েই সর্বপ্রথম সাংবাদিকতা বিষয়ক শিক্ষাদান শুরু হয়। পরবর্তীতে সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণের জন্য চালু হয় কলম্বিয়া স্কুল অফ জারনালিজম। ১৯১১ সালের ২৯শে অক্টোবর জোসেফ পুলিতজারের মৃত্যুর পর তার সম্মানে পুলিতজার পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়। ওদিকে র্যান্ডলফ হারস্ট রাজনীতিতে মনোনিবেশ করেন এবং এক সময়ে হলিউডে প্রতিষ্ঠিত হন। র্যান্ডলফ হারস্টের জীবনী নিয়ে বিখ্যাত নির্মাতা অরসন ওয়েলস তৈরি করে সর্বকালের অন্যতম সেরা একটি চলচিত্র ‘সিটিজেন কেইন’। এই দুই মহারথীর তিক্ত লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে সংবাদপত্র শিল্পের বিপ্লব সাধিত হয়। বর্তমানে আধুনিক গণমাধ্যম জগতের যে রূপরেখা আমরা দেখতে পাই তার ভিত্তি স্থাপিত হয় মুলত পুলিতজার ও হারস্টের দ্বৈরথের মধ্য দিয়ে।